Time & Date::
আসসালামু আলাইকুম। ভিজিট করার জন্য আপনাকে স্বাগতম।। এই ওয়েব ব্লগটি সকল মুসলিম ভাইবোনদের জন্য উৎসর্গ করা হলো আলহামদুলিল্লাহ। অনুগ্রহ করে নিয়মিত চোখ রাখুন।। কারও কোনো জিজ্ঞাস্য থাকলে অনুগ্রহ করে নিচে 'যোগাযোগ' লিংকে ক্লিক করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

ইসলামে আত্মীয়তা রক্ষার গুরুত্ব এবং আত্মীয়তা ছিন্নতার ভয়াবহ পরিণাম

ইসলামে আত্মীয়তা রক্ষার গুরুত্ব এবং আত্মীয়তা ছিন্নতার ভয়াবহ পরিণাম
ক) আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার ফযীলত:
আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার ফযীলত বহুবিধ। তন্মধ্যে কতিপয় দিক এখানে উল্লেখ করা হ’ল।-

১. আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানের পরিচায়ক:
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ঈমানের পরিচায়ক। রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে’। (বুখারী, ৬১৩৮)

২. আল্লাহর আনুগত্যের প্রকাশ:
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা আল্লাহর আনুগত্য করার বহিঃপ্রকাশ। মহান আল্লাহ বলেন, 'আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন যারা তা অক্ষুণ্ণ রাখে, ভয় করে তাদের প্রতিপালককে এবং ভয় করে কঠোর হিসাবকে’ (রা‘দ ১৩/২১)।

৩. আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম:
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, 'রেহেম’ (রক্তের বাঁধন) ‘রহমানের’ অংশ বিশেষ। সে বলবে, ‘হে প্রভু! আমি মাযলূম, আমি ছিন্নকৃত। হে প্রভু! আমার সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়। হে প্রভু! হে প্রভু! তখন তার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা জবাব দিবেন, তুমি কি সন্তুষ্ট নও যে, যে ব্যক্তি তোমাকে ছিন্ন করবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব এবং যে তোমাকে যুক্ত করবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক জুড়ে রাখব’? (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৫, সনদ ছহীহ।)

৪. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অছিয়ত প্রতিপালন করা:
নবী করীম (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে স্বীয় উম্মতকে বিভিন্ন বিষয়ে অছিয়ত করেছেন। তন্মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা অন্যতম। সুতরাং আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা হ’লে তাঁর উপদেশ প্রতিপালন করা হবে। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, আবু যর গিফারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমার বন্ধু নবী করীম (ছাঃ) আমাকে কতিপয় উত্তম গুণের ব্যাপারে উপদেশ দেন। তিনি আমাকে উপদেশ দেন যে, আমি যেন আমার চেয়ে উঁচু স্তরের লোকের দিকে লক্ষ্য না করি; বরং আমার চেয়ে নিম্নস্তরের লোকের দিকে তাকাই। তিনি আরো উপদেশ দেন, দরিদ্রদের ভালবাসতে ও তাদের নিকটবর্তী হ’তে। তিনি উপদেশ দেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে, যদিও তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে...’। (ছহীহ আত-তারগীব হা/২৫২৫, সনদ ছহীহ।)

৫. আল্লাহর নিকট অন্যতম প্রিয় আমল:
মানুষের কৃত অনেক আমল আল্লাহর নিকটে প্রিয় ও পসন্দনীয়। তন্মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা অন্যতম। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, ‘খাছ‘আম গোত্রের জনৈক লোক হ’তে বর্ণিত সে বলল, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর দরবারে আসলাম। তিনি তখন ছাহাবীদের একটি ক্ষুদ্র দলের সাথে ছিলেন। আমি বললাম, আপনিতো সেই ব্যক্তি যিনি ধারণা করেন যে, আপনি আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাবী বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কোন আমল আল্লাহর নিকটে পসনদনীয়? তিনি বললেন, আল্লাহর উপরে ঈমান আনা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কোন আমল আল্লাহর নিকটে অপসন্দনীয়? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, গর্হিত কাজের নির্দেশ দেওয়া এবং সৎকাজে নিষেধ করা’। (ছহীহ আত-তারগীব হা/২৫২২, সনদ ছহীহ।)

৬. বয়স ও রিযিক বৃদ্ধির উপায়:
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে মানুষের বয়স ও জীবিকা বৃদ্ধি পায়। এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে চায় যে, তার জীবিকা প্রশস্ত হোক এবং আয়ু বৃদ্ধি পাক, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সাথে ঘনিষ্ঠ আচরণ করে’। (বুখারী হা/২০৬৭, ৫৯৮৫; মুসলিম হা/২৫৫৭)

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যে তার জীবিকার প্রশস্ততা এবং আয়ু বৃদ্ধি পসন্দ করে, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম আচরণ করে’। (বুখারী হা/৫৯৮৬; মুসলিম হা/২৫৫৭)

এখানে বয়স বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে হায়াতে বরকত লাভ করা। সেই সাথে সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ দেহ, শক্তিমত্তা এবং অধিক কাজ করার ক্ষমতা লাভ করা। (কাতী‘আতুর রাহিমু, ১/৯ পৃঃ)

কেউ কেউ বলেন, বয়স ও রিযিক বৃদ্ধির তাৎপর্য হচ্ছে যে, আল্লাহ প্রকৃতই বান্দার বয়স ও জীবিকা বাড়িয়ে দেন। এখানে এ প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ নেই যে, বয়স ও রিযিক নির্ধারিত; সুতরাং তা কিভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে? কেননা হায়াত ও রিযক দু’ধরনের। যথা- ১. সাধারণ, যা কেবল আল্লাহ জানেন। এটা অপরিবর্তিত। ২. লিপিবদ্ধ, যা তিনি ফেরেশতাদের মাধ্যমে লিখিয়েছেন ও তাদের অবহিত করেছেন; বিভিন্ন কারণ ও ঘটনার প্রেক্ষিতে এটা হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমু‘ ফাতাওয়া, ৮/৫১৭, ৫৪০)

৭. আত্মীয়দের মাঝে পারস্পরিক মুহাববত বৃদ্ধির মাধ্যম:
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ভালবাসার বন্ধন সুদৃঢ় হয়। হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালককে ভয় করে এবং তার আত্মীয়-স্বজনকে জুড়ে রাখে, তার মৃত্যু পিছিয়ে দেওয়া হয়, তার সম্পদ বৃদ্ধি করা হয় এবং তার পরিবার-পরিজন তাকে ভালবাসে’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৮, সনদ হাসান)

অন্য শব্দে এসেছে এভাবে, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালককে ভয় করে, আত্মীয়তার বন্ধন জুড়ে রাখে, তার আয়ু বর্ধিত করা হয়, তার ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করা হয় এবং তার পরিবার-পরিজন তাকে ভালবাসে। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯, সনদ হাসান)

তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা তোমাদের বংশপরিচয় শিখে নাও, যা দ্বারা তোমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে। কেননা আত্মীয়তার সম্পর্ক পরিবার-পরিজনের মধ্যে হৃদ্যতা বৃদ্ধি করে, সম্পদ বাড়ায় এবং বয়স বৃদ্ধি করে’। (তিরমিযী হা/১৯৭৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭৬; মিশকাত হা/৪৯৩৪)

৮. পৃথিবীর অধিবাসীদের উন্নয়ন:
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা পৃথিবীবাসীদের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে এবং তাদের বয়স বৃদ্ধি করে। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) তাকে বলেছেন, ‘যাকে নম্রতা দান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের বহু কল্যাণ দেওয়া হয়েছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা, উত্তম চরিত্র ও সৎ প্রতিবেশী দুনিয়ার অধিবাসীদের উন্নয়ন ঘটায় এবং বয়স বৃদ্ধি করে’। (মুসনাদ আহমাদ; সিলিসিলা ছহীহাহ হা/৫১৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৫২৪)

৯. দ্রুত ছওয়াব লাভের উপায়:
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখলে অবিলম্বে ছওয়াব বা প্রতিদান লাভ করা যায়। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর আনুগত্যে সম্পন্ন এমন কোন কাজ নেই, যার মাধ্যমে দ্রুত ছওয়াব লাভ করা যায় আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ব্যতীত। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ও বিদ্রোহ করা ব্যতীত কোন কাজে দ্রুত শাস্তি আপতিত হয় না’। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা ১০/৬২; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৩৯১; ছহীহাহ হা/৯৭৮)

১০. আত্মীয়তার সম্পর্ক ক্বিয়ামতের দিন সাক্ষী দিবে:
যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে ক্বিয়ামতের দিন অপরাপর আত্মীয়-স্বজন তার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘রক্তের বন্ধন ক্বিয়ামতের দিন তার সংশ্লিষ্টজনের সম্মুখে এসে দাঁড়াবে এবং যদি সে তাকে দুনিয়ায় যুক্ত রেখে থাকে, তবে সে তার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে, যদি সে তাকে দুনিয়ায় ছিন্ন করে থাকে, তবে সে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭৭)

১১. জান্নাতে প্রবেশের উত্তম মাধ্যম:
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে জান্নাতে প্রবেশ করা সহজ হয়। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, বারা ইবনু আযীব (রাঃ) বলেন, একদা জনৈক বেদুঈন নবী করীম (ছাঃ)-এর খেদমতে এসে আরয করল, হে আল্লাহর নবী (ছাঃ)! আমাকে এমন একটি আমল শিক্ষা দিন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘তোমার কথা যদি এই পর্যন্তই হয়ে থাকে, তবে একটা প্রশ্নের মতো প্রশ্নই তুমি করেছ। গোলাম আযাদ কর এবং গর্দান মুক্ত কর’। সে ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! দু’টা একই বস্ত্ত নয় কি? নবী করীম (ছাঃ) বললেন, না, গোলাম আযাদ করা তো কোন গোলামকে আযাদ করাই এবং গর্দান মুক্ত করা মানে আত্মীয়-স্বজনের মুক্তির জন্য সাহায্য করা এবং প্রিয় বস্ত্ত (অর্থ-সম্পদ) দান করা। যদি তা না পার, তবে ক্ষুধার্তকে খাদ্য খাওয়াবে, পিপাসার্তকে পানি পান করাবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে। যদি তাতেও সমর্থ না হও, তবে কল্যাণকর কথা ব্যতীত তোমার মুখ বন্ধ রাখবে’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৮; মিশকাত হা/৩৩৮৪, সনদ ছহীহ)

অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘হে লোক সকল! পরস্পর সালাম বিনিময় কর, অন্যকে খাদ্য খাওয়াও, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ, রাতে ছালাত আদায় কর মানুষ যখন ঘুমন্ত থাকে, নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ কর’। ইবনু মাজাহ হা/৩৩৭৪; মিশকাত হা/১৯০৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫৬৯)


খ) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার অর্থ:
আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট ও ছিন্ন হওয়ার অর্থ ও তাৎপর্য হচ্ছে জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর সাথে দুর্ব্যবহার করা, তাদের প্রতি অনুগ্রহ, অনুকম্পা পরিহার করা, পূর্ববর্তী আত্মীয়দের বংশধরদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা, শারঈ ওযর ব্যতীত তাদের প্রতি ইহসান না করা, কারো প্রতি আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট করার দোষ চাপানো ইত্যাদি। (মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম আল-হামদ, কাতী‘আতুর রাহিম, পৃঃ ২)

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার হুকুম:
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা কবীরা গোনাহ। (ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়িমাহ ২৫/২৪৭)। কেননা আল্লাহ আত্মীয়দের সাথে সদাচরণ করতে এবং তাদের হক যথাযথভাবে আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন (নিসা ৪/৩৬; বানী ইসরাঈল ১৭/২৬-২৭)। অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন (বুখারী হা/১৩৯৬) এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না বলে উল্লেখ করেছেন (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৪, সনদ ছহীহ)। বিশেষ করে পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা হারাম (বুখারী হা/২৪০৮; মুসলিম হা/২৫৯৩; বুখারী হা/২৬৫৪; মুসলিম হা/৮৭; তিরমিযী হা/১৯০১)। আর অন্যান্য আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা গোনাহের কারণ, যা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে।

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার অপকারিতা ও পাপ:
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা অতি বড় গোনাহের কাজ। এর ফলে পারস্পরিক বন্ধন নষ্ট হয়, বংশীয় সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হয়, শত্রুতা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়, বিচ্ছিন্নতা ও একে অপরকে পরিত্যাগ করা অবধারিত হয়। এটা পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, হৃদ্যতা ও ভালবাসা দূর করে, অভিশাপ ও শাস্তি ত্বরান্বিত করে, জান্নাতে প্রবেশের পথকে বাধাগ্রস্ত করে, হীনতা ও লাঞ্ছনা আবশ্যক করে। এছাড়া এর কারণে মানবমনে চিন্তা ও পেরেশানী বৃদ্ধি পায়। কেননা মানুষ যার নিকট থেকে ভাল ব্যবহার, কল্যাণ ও সুসম্পর্ক কামনা করে, তার পক্ষ থেকে কোন বিপদ আসলে সেটা অধিক পীড়াদায়ক ও অসহনীয় হয়। এতদ্ব্যতীত পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বর্ণনামতে জ্ঞাতি সম্পর্ক ছিন্ন করার কিছু পাপ ও অপকারিতা নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-

১. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী অভিশপ্ত:
কুরআন মাজীদে আল্লাহ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীকে অভিশপ্ত বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হ’লে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আল্লাহ এদেরকে লা‘নত করেন এবং করেন বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২২-২৩)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুর রহমান ইবনু নাছের আস-সা‘দী বলেন, এতে দু’টি বিষয় রয়েছে। ১. আল্লাহর আনুগত্য আবশ্যকীয় করে নেয়া এবং তাঁর আদেশকে যথার্থভাবে পালন করা। এটা কল্যাণ, হেদায়াত ও কামিয়াবী। ২. আল্লাহর আনুগত্য থেকে বিমুখ হওয়া, তাঁর নির্দেশ প্রতিপালন না করা। যার দ্বারা দুনিয়াতে কেবল বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। আর এ বিপর্যয় সৃষ্টি হয় পাপাচার ও অবাধ্যতামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে এবং জ্ঞাতি বন্ধন ছিন্ন করার কারণে। তারাই ঐসকল লোক যারা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার মাধ্যমে। আল্লাহ স্বীয় রহমত থেকে তাদেরকে দূর করে দিয়ে এবং তাঁর ক্রোধের নিকটবর্তী করে তাদের অভিসম্পাত করেন’। (আব্দুর রহমান ইবনু নাছের আস-সা‘দী, তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, ১/৭/৮৮, সূরা মুহাম্মাদ ২২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ)।

অন্যত্র তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের জন্য আছে লা‘নত এবং তাদের জন্য আছে মন্দ আবাস’ (রা‘দ ১৩/২৫)।

২. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ক্ষতিগ্রস্ত ফাসেকদের দলভুক্ত:
জ্ঞাতি সম্পর্ক বিনষ্টকারী পাপাচারী ও ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘বস্ত্তত তিনি ফাসেকদের ব্যতীত কাউকে বিভ্রান্ত করেন না। যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত’ (বাক্বারাহ ২/২৬-২৭)।

৩. পার্থিব শাস্তি ত্বরান্বিত হওয়া ও পরকালীন শাস্তি বাকী থাকা:
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার কারণে পরকালে কঠোর শাস্তি তো রয়েছেই। তাছাড়া দুনিয়াতেও তাদের দ্রুত শাস্তি হবে। আবু বকর (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বিদ্রোহী ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর ন্যায় অন্য কাউকে পৃথিবীতে দ্রুত শাস্তি দেয়ার পরও পরকালীন শাস্তিও তার জন্য জমা করে রাখেননি’। (আবু দাঊদ হা/৪৯০২; তিরমিযী হা/২৫১১; ইবনু মাজাহ হা/৪২১১; মিশকাত হা/৪৯৩২)।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন এবং বিদ্রোহের মত দুনিয়াতেই ত্বরিৎ শাস্তির উপযুক্ত আর কোন পাপ নেই। পরকালে তার জন্য যে শাস্তি সঞ্চিত রাখা হবে, তা তো আছেই’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৭, সনদ ছহীহ)।

৪. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর সাথে আল্লাহ সম্পর্ক ছিন্ন করেন:
যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে মহান আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা যখন সমস্ত সৃষ্টি জগতকে সৃষ্টি করলেন, তখন ‘রেহেম (আত্মীয়তা)’ উঠে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কোমর ধরল। আল্লাহ তা‘আলা জিজ্ঞেস করলেন, কি চাও? সে বলল, এটা হ’ল আত্মীয়তা ছিন্নকারী হ’তে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার স্থান! তিনি বললেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, যে তোমার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে, আমিও তাকে ছিনণ করব? রেহেম বলল, জ্বী হ্যাঁ, প্রভু! তিনি বললেন, এটা তো তোমারই জন্য। অতঃপর আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, ইচ্ছা হ’লে পড়তে পার, ‘তবে কি (হে মুনাফিক সমাজ!) তোমরা আধিপত্য লাভ করলে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন সমূহকে ছিন্ন করবে’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২২)। (আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৫০, সনদ ছহীহ)।

রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, আমিই রহমান (দয়ালু), আমি আমার নাম (রহমান) থেকেই ‘রাহেম’ (আত্মীয়তার বন্ধন)-এর নাম নির্গত করেছি। সুতরাং যে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব এবং যে তাকে ছিন্ন করবে, আমি তাকে আমা হ’তে ছিন্ন করব’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৩, সনদ ছহীহ)।

৫. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না:
জ্ঞাতি সম্পর্ক বিনষ্টকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (বুখারী হা/৫৯৮৪; মুসলিম, হা/২৫৫৬; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৪)। তিনি আরো বলেন, ‘জান্নাতে প্রবেশ করবে না মদ পানকারী, জাদুতে বিশ্বাসী ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী’ (সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৭৮)।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা অতি বড় গোনাহের কাজ। একাজের মাধ্যমে দুনিয়াতে বিভিন্ন লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও শাস্তি রয়েছে, পরকালে তো বটেই। তাই আমাদেরকে এ থেকে সাবধান হ’তে হবে এবং আত্মীয়তা সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। এমনকি আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীদের থেকে দূরে থাকা যরূরী। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) বালক ও নির্বোধদের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব হ’তে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। রাবী সাঈদ ইবনু সাম‘আন (রাঃ) বলেন, ইবনু হাসানা জুহানী তাঁকে বলেছেন, তিনি আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন যে, এর নিদর্শন কি? তিনি বললেন, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা হবে, বিভ্রান্তকারীর আনুগত্য করা হবে এবং সৎপথ প্রদর্শনকারীর অবাধ্যতা করা হবে (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৬, সনদ ছহীহ)।

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা অতীব যরূরী। কেননা এটা হায়াত ও রিযক বৃদ্ধির মাধ্যম এবং জান্নাত লাভের উপায়। পক্ষান্তরে আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট করা জান্নাত থেকে মাহরূম হওয়ার কারণ। এজন্য রাসূল (ছাঃ) তাঁর মৃত্যুশয্যায় থাকাকালে উম্মতকে সাবধান করে বলেন, أَرْحَامَكُمْ أَرْحَامَكُمْ ‘তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন’ (সম্পর্কে সাবধান হও)। (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৩৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৭৩৬, ১৫৩৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৮৯৪, সনদ ছহীহ)।

অতএব প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ-নারীকে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। (আমীন!)
Read More

রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারী

রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারী
কারো সম্পদ আত্মসাৎ করা জঘন্য অপরাধ। আর যদি তা বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ হয় তাহলে অপরাধের মাত্রা আরো বেশি। অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ ইসলামের দৃষ্টিতে কাবীরা গুনাহ। যা সহজে ক্ষমা হয় না। সম্পদ আত্মসাৎ করার পরিণামও খুব ভয়াবহ। এরূপ খিয়ানতকারীকে আল্লাহ তা‘আলা ভালোবাসেন না। তাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেন। এমর্মে এরশাদ হচ্ছে- اِنَّ اللّٰہَ  لَا یُحِبُّ الۡخَآئِنِیۡنَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা খিয়ানতকারীদেরকে ভালোবাসেন না’ (সূরা আল-আনফাল : ৫৮)। যাকে যে বিষয়ে দায়িত্বশীল নিয়োগ করা হয়েছে তা যথাযথভাবে পালন করা উচিত। স্বীয় দায়িত্বে কোন প্রকার গাফিলতি করা উচিত নয়। কেননা ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।

আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘মনে রেখো, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে’। [১]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১৩৮; আবুদাউদ, হা/২৯২৮; তিরমিযী, হা/১৭০৫; আহমাদ, হা/৫১৬৭; মিশকাত, হা/৩৬৮৫।

যাকে যে কাজের জন্য দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছে সে সম্পর্কে তাকে বিচারের মাঠে জবাবদিহিতা করতে হবে। যেখানে কোন রকম ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকবে না। তাই স্ব স্ব দায়িত্ব আমনতদারিতার সাথে সঠিকভাবে পালন করা উচিত। যেন পরকালে জবাব দেয়া সহজ হয়।

*ন্যায়পরায়ণ শাসকের মর্যাদা*

ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায়পরায়ণ শাসকের মর্যাদা অনেক বেশি। বর্ণিত হয়েছে- ইয়ায ইবনু হিমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, ‘জান্নাতী তিন প্রকার। (১) ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ, যাকে ভাল কাজ করার তাওফীক্ব দেয়া হয়েছে। (২) ঐ ব্যক্তি যে প্রত্যেক আত্মীয়-স্বজন ও মুসলিমের প্রতি দয়ালু ও ন¤্র-হৃদয় এবং¹a (৩) সেই ব্যক্তি যে বহু সন্তানের (গরীব) পিতা হওয়া সত্ত্বেও  হারাম ও ভিক্ষাবৃত্তি থেকে দূরে থাকে’। [২]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৬৫; আহমাদ, হা/১৮৩৬৬; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৭৪৫৩; বায়হাক্বী শু‘আবুল ঈমান, হা/৭৩৫৯; মিশকাত, হা/৪৯৬০।

আরেক বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘হাশরের মাঠে আল্লাহ সাত শ্রেণীর ব্যক্তিকে স্বীয় আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন। তন্মধ্যে এক শ্রেণী হচ্ছে- ন্যায়পরায়ণ শাসক’। [৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬০; তিরমিযী, হা/২৩৯১; নাসাঈ, হা/৫৩৮০; আহমাদ, হা/৯৬৬৩; মিশকাত, হা/৭০১।

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘ন্যায় বিচারকগণ (ক্বিয়ামতের দিন) আল্লাহর নিকটে নূরের মিম্বারসমূহে মহা মহিমান্বিত দয়াময় প্রভুর ডানপার্শ্বে উপবিষ্ট থাকবেন। তাঁর উভয় হাতই ডান হাত (সমান মহিয়ান)। যারা তাদের শাসনকার্যে তাদের পরিবারের লোকদের ব্যাপারে এবং তাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বসমূহের ব্যাপারে সুবিচার করে’। [৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২৭; আহমাদ, হা/৬৪৯২; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৪৮৪; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/২৫১৬৯; মিশকাত, হা/৩৬৯০।

সঠিকভাবে স্বীয় দায়িত্ব পালনকারীর মর্যাদা অনেক বেশি। এমন ন্যায়পরায়ণ শাসক আরশের ছায়ায় স্থান পাবে। তাছাড়া জান্নাত লাভে ধন্য হবে। এমনকি বিচারের মাঠে আল্লাহর পাশে আসন লাভ করবে।

*অত্যাচারী শাসক নিকৃষ্ট ব্যক্তি*

জনগণের উপর অত্যাচরী শাসক খুবই নিকৃষ্ট। তাদের পরকালীন ফলাফলও অত্যন্ত কষ্টদায়ক। এরূপ শাসককে আল্লাহ তা‘আলা ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেন।

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয় নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে অধীনস্ত জনগণের প্রতি অত্যাচার করে। [৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৩০; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৫১১; মিশকাত, হা/৩৬৮৮।

অপর এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! কোন ব্যক্তি যদি আমার উম্মতের সামান্য কাজের দায়িত্বশীল হয় তারপর সে অধীনস্ত লোকের প্রতি কঠোরতা করে আপনি তার উপর কঠোর হোন। আর যে ব্যক্তি আমার উম্মতের সামান্য কাজের দায়িত্বশীল হয় তাদের উপর নরম হয় আপনি তার উপর নরম হোন’। [৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮২৮; আহমাদ, হা/২৪৬৬৬; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৫৩; ত্বাবারাণী আওসাত, হা/৯৪৪৯; মিশকাত, হা/৩৬৮৯।

অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির সাথে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা কথা বলবেন না, তাদের (গুনাহ থেকে) পবিত্র করবেন না। তাদের প্রতি তাকাবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। (এরা হল) বুড়ো ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী শাসক বা রাষ্ট্রপ্রধান ও অহংকারী দরিদ্র ব্যক্তি’। [৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৭; আহমাদ, হা/১০২৩২; বায়হাক্বী শু‘আবুল ঈমান, হা/৮১৫৫; মুসনাদে আবু আওয়ানাহ, হা/১১৪; ছহীহুল জামে‘, হা/৩০৬৯; মিশকাত, হা/৫১০৯।

অধীনস্ত জনগণের উপর অত্যাচারকারী শাসক সর্বাধিক নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল। এরূপ শাসকের উপর আল্লাহ তা‘আলা রহম করেন না। তার উপর কঠোরতা আরোপ করেন। তাদের সাথে তিনি বিচার দিবসে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না, কথাও বলবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

*আত্মসাৎকৃত বস্তু নিয়েই বিচারের মাঠে উঠবে*

অন্যের জিনিস আত্মসাৎ করা খুবই নোংরা স্বভাব। তারা মানসিকভাবে নীচু শ্রেণীর ব্যক্তির মধ্যে গণ্য। কোন রুচিশীল ভদ্র মানুষ এমন করতে পারে না। তাই তো যে যা আত্মসাৎ করবে, তাই নিয়ে বিচারের মাঠে উপস্থিত হবে।

‘*কোন নবীর জন্য শোভনীয় নয় যে, তিনি খিয়ানত করবেন। আর যে লোক খিয়ানত করবে সে ক্বিয়ামতের দিন সেই খিয়ানত করা বস্তু নিয়ে উপস্থিত হবে। অতঃপর প্রত্যেকেই পরিপূর্ণভাবে পাবে যা সে অর্জন করেছে। আর তাদের প্রতি কোন অন্যায় করা হবে না’ (সূরা আলে ইমরান : ১৬১)।*

হাদীছে এসেছে, আদী ইবনু আমিরা আল-কিন্দী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আমি যাকে তোমাদের কোন কাজের দায়িত্বশীল করি, অতঃপর সে সূচ পরিমাণ বস্তু বা তার চেয়ে বেশি সম্পদ আত্মসাৎ করল, সেটাই হবে খিয়ানত। ক্বিয়ামতের দিন সেই বস্তু নিয়ে সে উপস্থিত হবে। [৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৩৩; আহমাদ, হা/১৭৭৫৯; ত্বাবারাণী কাবীর, হা/২৫৬; ছহীহুল জামে‘, হা/৬০২৪; ছহীহ আত-তারগীব, হা/৭৮১; মিশকাত, হা/১৭৮০।

অপর বর্ণনায় রয়েছে- আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা নবী করীম (ﷺ) আমাদের মাঝে বক্তব্য দেয়ার জন্য দাঁড়ালেন, তিনি খিয়ানত সম্পর্কে বক্তব্য দিলেন এবং খিয়ানতের বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে পেশ করলেন। তারপর তিনি বললেন, ক্বিয়ামতের দিন তোমাদের কাউকে আমি এমন অবস্থায় পাব যে, তার কাঁধের উপর উট চিৎকার করতে থাকবে। সে বলবে, হে আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ)! আমাকে রক্ষা করুন। আমি বলব, আজ আল্লাহ্র সামনে তোমার জন্য সামান্য কিছু করার ক্ষমতা আমি রাখি না যা পূর্বেই বলেছি। ক্বিয়ামতের দিন আমি তোমাদের কাউকে এমন অবস্থায় পাব যে তার কাঁধের উপর ঘোড়া চিৎকার করতে থাকবে। সে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাকে রক্ষা করুন, আমি বলব, আজ আল্লাহর সামনে তোমার জন্য সামান্য কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই যা আমি পূর্বেই বলেছি। ক্বিয়ামতের দিন আমি যেন তোমাদের কাউকে এই অবস্থায় দেখতে না পাই যে, সে কাঁধের উপর একটি ছাগল বহন করছে এবং আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাকে সাহায্য করুন। আর আমি বলব আমি কিছুই করতে পারব না। আমিতো তোমাকে আল্লাহর বিধান পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছি।

ক্বিয়ামতের দিন আমি যেন তোমাদের কাউকে এমন অবস্থায় দেখতে না পাই যে, সে নিজের কাঁধের উপর চিৎকাররত একটি মানুষ বহন করে নিয়ে আসবে আর আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাকে সাহায্য করুন। আর আমি বলব, আজ আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারব না। আমি আল্লাহর বিধান তোমাকে পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছি। ক্বিয়ামতের দিন আমি যেন তোমাদের কাউকে এ অবস্থায় দেখতে না পাই যে, সে নিজের কাঁধের উপর কাপড় ইত্যাদির এক খন্ড বহন করে নিয়ে আসছে। আর উহা ভীষণভাবে তার কাঁধের উপর দুলছে, তখন সে আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাকে সাহায্য করুন, আর আমি বলব, আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারব না। ক্বিয়ামতে আমি যেন তোমাদের কাউকে এমন অবস্থায় না দেখতে পাই যে, সে নিজের কাঁধের উপর অচেতন সম্পদ (সোনা চাঁদি) বহন করে নিয়ে আসছে। আর আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাকে সাহায্য করুন। আর আমি বলব, আজ আমি তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারব না। আমি তো তোমাকে আল্লাহর বিধান পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছি। [৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৩০৭৩; আহমাদ, হা/৯৪৯৯; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৮৪৭; বায়হাক্বী, হা/৪৩৩০; মিশকাত, হা/৩৯৯৬।

*যে ব্যক্তি অন্যের বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ হতে যে বস্তু আত্মসাৎ করবে হাশরের ময়দানে সেদিন তাই নিয়ে হাযির হবে। সেটা কোন প্রাণী হোক, স্থাবর সম্পদ হোক অথবা কোন বস্তু। যারা অন্যয়ভাবে মানুষের সম্পদ ভোগ করছে বা রাষ্ট্রের সম্পদ অত্মসাৎ করছে তাদের সেদিন অবস্থা হবে খুবই লজ্জাকর। যারা সরকারী ত্রাণ চুরি করছে তাদের এ বিষয়ে ভাবা উচিত। যারা ত্রাণের টাকা, চাল, ডাল, তেল প্রভৃতি জিনিস আত্মসাৎ করছে তাদেরকে এসব জিনিসি নিয়েই বিচারের মাঠে উপস্থিত হতে হবে। সেদিন সারা পৃথিবীর মানুষ দেখে আত্মসাৎকারীকে চিনতে পারবে। গোটা জাহানের মানুষের সামনে অপমান হতে বাঁচতে চাইলে এসব ফেরত দিয়ে তওবা করা উচিত।*

*আত্মসাতকারীর জন্য জান্নাত হারাম*

আত্মসাৎকারী ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম করা হয়েছে। তারা জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ পাবে না। এমর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে- মা‘ক্বিল ইবনু ইয়াসার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, কোন ব্যক্তি মুসলিমের দায়িত্ব গ্রহণের পর খিয়ানত অবস্থায় মারা গেলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করেছেন। [১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১৫১; ছহীহ মুসলিম, হা/৩৮০; আহমাদ, হা/২০৩০৬; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৪৯৫; দারেমী, হা/২৭৯৬; মিশকাত, হা/৩৬৮৬।

মা‘ক্বিল ইবনু ইয়াসার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, যার প্রতি আল্লাহ কোন দায়িত্ব অর্পণ করেন, অতঃপর সে সুষ্ঠুভাবে তা পালন করে না, সে জান্নাতের গন্ধ পাবে না। [১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১৫০; ছহীহ আত-তারগীব, হা/২২০৪; মিশকাত, হা/৩৬৮৭।

মা‘ক্বিল ইবনু ইয়াসার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, যে কোন আমীর (শাসক) মুসলিমদের দেখাশুনার দায়িত্ব নিল, অতঃপর সে তাদের (সমস্যা দূর করার) চেষ্টা করল না এবং তাদের হিতাকাক্সক্ষী না, সে তাদের সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করবে না’। [১২]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪২; ত্বাবারাণী কাবীর, হা/৫২৪; শু‘আবুল ঈমান, হা/৬৯৭৮; মুসনাদে আবী আওয়ানাহ, হা/৭০৪৩; ছহীহুল জামে‘, হা/৫৬৯৭।

কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি খিয়ানত বা আত্মসাৎ করা অবস্থায় মারা গেলে তার জন্য জান্নাত হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। দায়িত্বে নিযুক্ত হওয়ার পর সঠিকভাবে স্বীয় দায়িত্ব পালন না করলে জান্নাতের সুগন্ধিও লাভ করতে পারবে না। দায়িত্বশীলকে সদা-সর্বদা জনগণের সমস্যাবলী দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। নিজ দায়িত্বে কোন অবহেলা করা যাবে না। মানুষের সাথে মিশুক হতে হবে। তাদের পাশে থাকতে হবে। অন্যথা এই দায়িত্বই তার জন্য ভয়াবহতায় রূপ নিবে।

*আত্মসাৎকারীর বাসস্থান হবে জাহান্নাম*

আত্মসাৎকারী ব্যক্তির জান্নাতে ঠায় হবে না। বিধায় তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নামে। আত্মসাতের সম্পদ দিয়ে দুনিয়ায় কিছুটা সুখ ভোগ করেছে। পরকালে তাকে এই সুখের মাসুল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বুঝিয়ে দিতে হবে।

খাওয়ালা আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, নিশ্চয় কিছু লোক আল্লাহর সম্পদ অন্যায়ভাবে দখল করবে। আর ক্বিয়ামতের দিন তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম। [১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৩১১৮; আহমাদ, হা/২৭৩৫৯; বুলুগুল মারাম, হা/১৪৯৩; ছহীহুল জামে‘, হা/২০৭৩; কানযুল উম্মাল, হা/১৬৭৫৭; মিশকাত, হা/৩৯৯৫।

ওবাদাহ ইবনু ছামিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, হুনাইনের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গনীমতের এক ক্ষুদ্র কণা পরিমাণ জিনিস হাতে করে বললেন, ‘হে উপস্থিত জনগণ! আমার হাতের এই ক্ষুদ্র অংশ তোমাদের গনীমতের মালের অন্তর্ভুক্ত। সূঁচ পরিমাণ বা তার চেয়ে কম-বেশি সম্পদ কারো নিকট থাকলে তা পেশ কর। নিশ্চয় খিয়ানত (আত্মসাৎ) ক্বিয়ামাতের দিন খিয়ানতকারীর জন্য অপমান-অপদস্ত ও জাহান্নামের কারণ হবে’। [১৪]. ইবনু মাজাহ, হা/২৮৫০; মুসনাদে বাযযার, হা/২৭১৪; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৯৮৫, হাদীছ ছহীহ।

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমাকে বললেন, খায়বারের যুদ্ধের দিন ছাহাবীগণের একটি দল বাড়ী ফিরে আসছিলেন। ঐ সময় ছাহাবীগণ বললেন, অমুক অমুক শহীদ, শেষ পর্যন্ত এমন এক ব্যক্তিকে ছাহাবীগণ শহীদ বললেন, যার ব্যাপারে রাসূল (ﷺ) বললেন, কখনো নয়, আমি তাকে জাহান্নামে দেখছি সে একটি চাদর অথবা আবায়া (এক ধরনের পোশাক) আত্মসাৎ করেছে’। [১৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৪; আহমাদ, হা/২০৩; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৮৫৭; শু‘আবুল ঈমান, হা/৪০২২; ছহীহ আত-তারগীব, হা/১৩৪৬; মিশকাত, হা/৪০৩৪।

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, নবী করীম (ﷺ)-এর গনীমতের মালের এক ব্যক্তি দায়িত্বশীল ছিল, যে কারকারা নামে পরিচিত। সে মারা গেলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে জাহান্নামী বলে ঘোষণা করেন। ছাহাবীগণ তার নিকট গিয়ে দেখলেন সে একটি চাদর আত্মসাৎ করেছিল’। [১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৩০৭৪; ইবনু মাজাহ, হা/২৮৪৯; আহমাদ, হা/৬৪৯৩; বায়হাক্বী কুবরা, হা/১৭৯৮২; ছহীহ আত-তারগীব, হা/১৩৪৪; মিশকাত, হা/৩৯৯৮।

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, মিদ‘আম নামে একটি গোলাম রাসূল (ﷺ)-কে হাদিয়া দিয়েছিল। মিদ‘আম এক সময় রাসূল (ﷺ)-এর উটের পিঠের হাওদা নামাচ্ছিল এমতাবস্থায় একটি তীর এসে তাকে লাগে এবং সে মারা যায়। ছাহাবীগণ বলেন, তার জন্য জান্নাত। রাসূল (ﷺ) বললেন, কখনই নয়। আল্লাহ্র কসম, নিশ্চয় ঐ চাদরটি যেটি সে খায়বারের গনীমত বণ্টন করার পূর্বে আত্মসাৎ করেছিল সে চাদরটি জাহান্নামের আগুন তার উপর উত্তেজিত করছে। এ কথা শুনে একজন লোক একটি জুতার ফিতা বা দু’টি জুতার ফিতা রাসূল (ﷺ)-এর নিকট নিয়ে আসল। রাসূল (ﷺ) বললেন, একটি বা দু’টি জুতার ফিতা আত্মসাৎ করলেও জাহান্নামে যাবে। [১৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৭০৭; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৪৮৫১; ছহীহ আত-তারগীব, হা/১৩৪৯; মিশকাত, হা/৩৯৯৭।

আত্মসাৎকারীর শেষ পরিণতি হবে জাহান্নাম। রাষ্ট্রে বা জনগণের সামান্য কোন জিনিস আত্মসাৎ করলেও পরিণাম একই। সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের জন্য হাদীছগুলো দিক নির্দেশক। আত্মসাৎ হলেই পরিণতি খুব ভয়ঙ্কর।

*হাশরের মাঠে আত্মসাৎকারীকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ উপস্থাপন করা হবে*

আত্মসাৎ, খিয়ানত এবং বিশ্বাসঘাতকতা ভয়ঙ্কর অপরাধ। যারা দুনিয়ায় এগুলোর সাথে জাড়িত হবে, তাদেরকে বিচারের মাঠে সকলের মাঝে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এমর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে- ইবনু উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের জন্য এক একটি পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং বলা হবে, ইহা উমুকের পুত্র উমুকের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক। [১৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৭৮; আবুদাউদ, হা/২৭৫৬; তিরমিযী, হা/১৫৮১; ইবনু মাজাহ, হা/২৮৭২; আহমাদ, হা/৫০৮৮; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৭৩৪৩; বায়হাক্বী কুবরা, হা/১৮৬২৬; মিশকাত, হা/৩৭২৫।

আবূ সাঈদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের নিতম্ভের (পিছনে) নিকট তার বিশ্বাসঘাতকতার পতাকা স্থাপন করা হবে’। [১৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৩৮; ছহীহুল জামে‘, হা/৫১৬৭; মিশকাত, হা/৩৭২৭।

অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, ‘ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের জন্য তার বিশ্বাসঘাতকতার পরিমাণ অনুযায়ী পতাকা উত্তোলন করা হবে। সাবধান! প্রধান শাসকের বিশ্বাসঘাতকতার পতাকাই হবে সবচেয়ে বড়’। [২০]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৩৮; কানযুল উম্মাল, হা/৪৬৮৪; মিশকাত, হা/৩৭২৭।

ক্বিয়ামত দিবসে হাশরের মাঠে প্রত্যেক আত্মসাৎকারী ও বিশ্বাসঘাতকের অবস্থা হবে খুবই লজ্জাকর। তাদের আত্মসাতের পরিমাণ অনুযায়ী পিছনে পতাকা উড়তে থাকবে। যেখানে তাদের প্রত্যেকের পরিচয় উল্লেখ করা হবে। বিষয়টি কতটা নোংরা ও অপমানজনক তা আত্মসাৎকারীদের অনুধাবন করা প্রয়োজন। বিচারের মাঠে অপমান থেকে বাঁচতে চাইলে সকল প্রকার খিয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতা বর্জন করা অপরিহার্য কর্তব্য।

সুধী পাঠক! যারা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছি তাদের বিষয়টি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। জনগণের জিনিসি অন্যায়ভাবে ভোগ করতে তাদের বিবেকে বাধা দেয় না। গভীরভাবে এ হাদীছগুলো তাদের ভাবা প্রয়োজন। সামান্য সুখ যেন আজীবনের কান্নায় রূপ না নেয়। সকলে সময় থাকতে সাবধান হই।

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘কেউ কারো প্রতি যদি সম্মানের ব্যাপারে বা কোন কিছুর ব্যাপারে অত্যাচার করে থাকে তাহলে আজকেই সে যেন তা সমাধা করে নেয়, ঐ দিন আসার পূর্বে যে দিন তার নিকট কোন অর্থ-সম্পদ থাকবে না। ঐ দিন সৎ আমল থাকলে অন্যায় পরিমাণ নিয়ে নেয়া হবে। আর সৎ আমল না থাকলে তার পাপগুলো নিয়ে অপরাধীর উপর চাপিয়ে দেয়া হবে’। [২১]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪৪৯; আহমাদ, হা/১০৫৮০; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৭৩৬১; ছহীহ আত-তারগীব, হা/২২২২; মিশকাত, হা/৫১২৬।

*অনুমতি না নিয়ে সরকারি বিদ্যুৎ চুরি করে ব্যবহার করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আলোকসজ্জা করলে বা অন্য কোনো ব্যক্তিগত কাজ করলে সেটা জায়েজ আছে কিনা?*

এটা পুরোপুরি নাজায়েজ ও হারাম একটি কাজ। কারণ এটা রাষ্ট্রের বা পুরো জাতির সম্পদ। এই সম্পদ অন্যায় ভাবে ব্যবহার করা কোনো ক্রমেই জায়েজ হবে না। এর সাথে সারা দেশের মানুষের হক্ব জড়িত। আর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ চুরি করে ব্যবহারের তো কোনো প্রশ্নই আসে না।  

কোনো একজন ব্যক্তির থেকে কোনো সম্পদ অন্যায় ভাবে আত্মসাৎ করলে, ঐ ব্যক্তি যদি কখনো মাফ করে দেয় তাহলে আল্লাহ ঐ আত্মসাৎকারীকে ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু দেশের বা জাতীয় সম্পদ যদি কেউ জবরদখল করে বা আত্মসাৎ করে তাহলে পুরো দেশবাসীর কাছেই অপরাধী হয়ে থাকতে হবে। এটা অসম্ভব যে দেশের কোটি কোটি মানুষ প্রত্যেক অপরাধীকে ক্ষমা করে দিবেন। তাই কিয়ামতের দিন পুরো দেশবাসীই ঐ আত্মসাৎকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করবেন।

তাই বান্দার হক্বের ব্যাপারে আমাদের যেমন সচেতন হতে হবে, একই রকম ভাবে আমরা দেশের বা সমাজের কোনো সম্পদ অন্যায় ভাবে ব্যবহার করছি কিনা সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। যারা সরকারি রাস্তা, সরকারি গাছ, সরকারি জমি ইত্যাদি; ছলে, বলে, কৌশলে ভোগ-দখল করেন; কিয়ামতের দিন তাদেরকে কত কোটি মানুষের মুখোমুখি হতে হবে তা চিন্তা করা যায় কি?

এরকম কোনো প্রয়োজনে আমরা নিজেদের বাসা-বাড়ি থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবহার করা উচিৎ। অন্যের বাসা বা দোকান থেকে সংযোগ নিলে তাদেরকে কিছু পেমেন্ট উচিৎ। অনুরোধ করে আবদার করে হলেও তাদের অনুমতি ক্রমে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা উচিৎ। অন্যথায় লক্ষ-কোটি মানুষের দাবীর নিচে আমাদেরকে থাকতে হবে। কিয়ামতের দিন নিজেদের নেক আমলগুলো ঐসকল দাবীদারকে দিয়ে দিতে হবে।

সরকার তো কোনো একক ব্যাক্তি নয়। অনেকগুলো মানুষ মিলে সরকার গঠন হয়। মোটকথা জনগণই সরকার এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত জনগনই সরকারি প্রতিনিধি। এর মধ্যে যারাই জালিম হবে তাদের সবাইকেই কিয়ামতের মাঠে কৈফিয়ত দিতে হবে। এরা জনগনের উপর জুলুম করলে জনগণকে কিয়ামতের দিন সওয়াব দিয়ে দিতে হবে। সওয়াব শেষ হয়ে গেলে গুনাহের বোঝা বইতে হবে। এটা আমাদের সবার জন্যই সমান। সরকারী লোক হই বা আম জনতা হই। ততটুকু পাপই করা উচিত, যতটুকুর শাস্তি ভোগ করতে আমরা রাজি আছি।

আল্লাহ তা‘আলা সকল মুসলিমকে সামান্য থেকে সামান্যতর আত্মসাৎ করার মত জঘন্য অপরাধ থেকে বিরত থাকার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!
Read More

প্রসঙ্গ: অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব/পূজা-পার্বণে মুসলিমদের যোগদান বা শুভেচ্ছা জ্ঞাপনঃ

প্রসঙ্গ: অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব/পূজা-পার্বণে মুসলিমদের যোগদান বা শুভেচ্ছা জ্ঞাপনঃ
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা লক্ষ্য করছি যে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব-আয়োজনে কিছু মুসলিম অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে অংশগ্রহণ করছে। এমন কি অনেক ব্যবসায়ী, রাজনীতিবীদ যথারীতি পোস্টার, ব্যানার, ফেইজবুক ইত্যাদির মাধ্যমে পূজা উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন বিনিময় করে নিজেদেরকে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে প্রমাণের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। মুসলিমদের জন্য রঙের উৎসব হোলি, আলোর উৎসব দেওয়ালি, কেকের উৎসব ক্রিস্টমাস, বাকি পুজোপার্বন, গুরুপূর্ণিমা, বৌদ্ধপূর্ণিমা, ইস্টার, এই সব হিন্দু, ক্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, ইহুদিদের ধর্মের যে কোনো আনন্দ উৎসবে অংশগ্রহণ করা সম্পূর্ণ ভাবে অবৈধ। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে র‍্যাগ ডে, অরিয়েন্টেশন, নবীনবরন গুলোয় আর স্ব স্ব ডিপার্টমেন্টের ফেস্টের দিনগুলোতে কথিত 'কালার ফেস্ট'-এর নামে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ছড়িয়ে পড়ছে।  এছাড়াও ওই সব ধর্মের যে কোনো, দেবতা, চিহ্ন, দেব দেবী বা মনীষীদের ছবিতে মাল্যদান ইত্যাদির প্রতি মাথানত করে সম্মান করা সম্পূর্ণ ভাবে অবৈধ ও অধার্মিক নাজায়েজ কাজ।

আরো মারাত্মক বিষয় হচ্ছে, এক শ্রেণীর মানুষ “ধর্ম যার যার উৎসব সবার” এ ধরনের শ্লোগান দিয়ে অমুসলিমদের উৎসবাদির সর্বজনীনতা প্রমাণেও মরিয়া হয়ে উঠেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইসলামের মৌল শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ অতি উৎসাহীরা এতে মহামারির মত আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি যেহেতু ঈমান-আক্কীদার সাথে সম্পৃক্ত, তাই কুরআন-সুন্নাহর আলোকে এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান সুস্পষ্ট হওয়া বাঞ্জনীয়। কুরআন-সুন্নাহ গবেষণা করে মুসলিম মনীষীগণ বলেছেন: অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব, পূজা-পার্বণে মুসলিমদের অংশগ্রহণ করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

*প্রমাণাদি:*

*প্রথমত: কুরআনের দলীল*

ক. আল্লাহর বাণী: “(আল্লাহর প্রকৃত বান্দাদের আরো একটি বৈশিষ্ট্য হলো) তারা যুর (অসার) কাজে যোগদান করে না”। (সূরা ফুরকান, আয়াত: ৭২)।

এ আয়াতে “যুর” এর ব্যাখ্যায় হযরত ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে: ﺃﻧﻪ ﺃﻋﻴﺎﺩ ﺍﻟﻤﺸﺮﻛﻴﻦ “যুর হচ্ছে, মুশরিকদের উৎসবাদি। অর্থাৎ আল্লাহর সৎ বান্দাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা জেনে শুনে আজে-বাজে কথা ও কাজ দেখতে বা শুনতে অথবা তাতে অংশ গ্রহণ করে না। আর যদি কখনো তাদের পথে এমন কোন জিনিস এসে যায়, তাহলে তার প্রতি একটা উড়ো নজর না দিয়েও তারা এভাবে সে জায়গা অতিক্রম করে যেমন একজন অত্যন্ত সুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তি কোন ময়লার স্তুপ অতিক্রম করে চলে যায়। [দেখুন: ফাতহুল কাদীর, কুরতুবী]

খ. আল্লাহর বাণী: “যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত”। (আল-ইমরান: ৮৫)

“আর যদি তোমরা কুফরী কর, তবে (জেনে রেখো) আল্লাহ তোমাদের মুখাপেক্ষী নন। তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য কাফের হয়ে পড়া পছন্দ করেন না”। (আযযুমার: ৭)

কাফিরদের উৎসবে অংশগ্রহণের অর্থ হলো, তাদের কুফর-শিরককে মেনে নেয়া, কিংবা তাতে সন্তোষ প্রকাশ করা। অতএব, তা কিছুতেই বৈধ হতে পারে না।

 গ. অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, “হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা (কখনো) ইয়াহুদী-খ্রীস্টানদের নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। (কেননা) এরা নিজেরা (সব সময়ই) একে অপরের বন্ধু; তোমাদের মধ্যে কেউ যদি এদের কাউকে বন্ধু বানিয়ে নেয়, তাহলে সে অবশ্যই তাদের দলভুক্ত হয়ে যাবে। আর আল্লাহ কখনো যালিম সম্প্রদায়কে পছন্দ করেন না” (সূরা আল-মাইদাহ: ৫১)।

“হে ঈমানদার ব্যক্তিরা! তোমরা (কখনো) আমার ও তোমাদের  দুশমনদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না, (এটা কেমন কথা,) তোমরা তাদের প্রতি বন্ধুত্ব দেখাচ্ছ। (অথচ) তোমাদের কাছে যে সত্য (দ্বীন) এসেছে তারা তা অস্বীকার করেছে”। (মুমতাহিনাহ: ১)

এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কাফিরদের পূজায় অংশগ্রহণ তাদের প্রতি এই নিষিদ্ধ বন্ধুত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। যা একজন মুমিনের জন্য শোভা পায় না।

ঘ. আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেন: “তোমরা পুণ্য ও তাকওয়ার কাজে পরস্পর সাহায্য করো। গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনে কেউ কাউকে সাহায্য করো না”। (আল-মাইদাহ: ২)

মূর্তিপূজায় অংশগ্রহণ বা শুভেচ্ছা জ্ঞাপন ইত্যাদি নিঃসন্দেহে গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনে সাহায্যের অন্তুর্ভুক্ত।

*দ্বিতীয়ত: হাদীসের দলীল:*

ক. রাসূল (স.) বলেন: “যে যেই জাতির সাথে সামঞ্জস্য রাখবে, সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে” (আবু দাউদ, আহমাদ)। 

এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবাদিতে যোগদান করা প্রকারান্তরে তাদের সাথে ধর্মপালনে, বিশ্বাস-চিন্তায় সামঞ্জস্য রাখারই অন্তর্ভুক্ত। অতএব,তা বৈধ হতে পারে না।

অন্য হাদীসে রয়েছে, “প্রত্যেক জাতিরই ঈদ/উৎসব আছে। এটি (ঈদুল ফিতর/ ঈদুল আদহা) হলো আমাদের ঈদ” (মুসলিম)।

এই হাদীসের মর্মার্থ হলো, পূজা-পার্বণ এগুলো কোন সামাজিক বা জাতীয় রীতি অনুষ্ঠান নয়; এগুলো একান্তই ধর্মীয় উৎসব। বরং এসব আনুষ্ঠানিকতাই হলো তাদের ধর্ম। এখানে ধর্ম থেকে উৎসবকে, কিংবা উৎসব থেকে ধর্মকে আলাদা করার কোন সুযোগ নেই। ইসলামের ঈদ (ঈদুল ফিতর, ঈদুল আদহা)ও ধর্মের অবিচ্ছিন্ন অংশ। এ জন্য তা তাকবীর ও নামায দিয়ে শুরু হয়। অমুসলিমদের তাতে অংশ গ্রহণের কোন সুযোগ নেই। কারণ, ঈমান ছাড়া নামাযের কোন দাম নেই। এছাড়াও, অমুসলিমরা মুসলিমদের ঈদের মৌলিক আনুষ্ঠানিকতায় অংশগ্রহণ করে না। যেমন, কুরবানী করা। যেখানে (উদহারণস্বরূপ) হিন্দুধর্মে গরু জবাই করা, গরুর গোশত খাওয়া নিষেধ, সেখানে কিভাবে তাদের অংশগ্রহণ কল্পনা করা যেতে পারে? তদ্রূপ, যেখানে মূর্তি পূজা ইসলামের দৃষ্টিতে মহা অপরাধ, শিরক, সেখানে কিভাবে মুসলিমগণ যোগদান করতে পারে? অতএব, “ধর্ম যার যার উৎসব সবার” এ জাতীয় শ্লোগান সম্পূর্ণরূপে একটি মিথ্যা ও ঈমান বিধ্বংসী কথা।

মূলত বিষয়টি নিছক পার্থিব জাগতিক কোন বিষয় নয়; বিষয়টি হচ্ছে আক্কীদাহগত দ্বীনি বিষয়। তাছাড়া, ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মকে সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন মনে করাও কুরআন বিরোধী কথা। কারণ, ইসলামই হচ্ছে সকল মানবতার পক্ষ থেকে আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র ধর্ম। সকল বিশ্ববাসির জন্য রহমত ও নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন মুহাম্মাদূর রাসূলুল্লাহ (স.)। একমাত্র ইসলামের সর্বাত্মক চূড়ান্ত শাশ্বত জীবন ব্যবস্থাই সব মানুষের জন্য সমানভাবে কল্যাণকর। এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সুপ্রমাণিত।

খ. রাসূল (স.) বলেন: “আমি তোমাদের জন্য হাওদের (হাওযে কাওসার) কাছে অপেক্ষা করতে থাকবো। যে ব্যক্তিই আমার পাশ দিয়ে যাবে, সেই (সেখান থেকে ) পান করবে। আর যে তা পান করবে, কখনোই সে আর পিপাসার্ত হবে না। একটি কওম আমার কাছে আসতে থাকবে, আমি তাদেরকে চিনবো, তারাও আমাকে চিনতে পারবে। তখন আমার ও তাদের মধ্যে পর্দা টেনে দেয়া হবে। আমি বলবো, তারাতো আমার (উম্মতের) অন্তর্ভুক্ত। তখন বলা হবে, তুমি জানো না তারা তোমার পরে কী সব ঘটিয়েছে। তখন আমি বলবো, দূর হও, দূর হও তোমরা যারা আমার পরে ইসলামকে বিকৃত করেছিলে।” (বুখারী, মুসলিম)

যারা অমুসলিমদের উৎসবে যোগদান করাকে ইসলামের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশর করছে, তারা মূলত ইসলামকে বরং সত্যকে বিকৃত করছে। তারা পরকালে রাসূলের হাতে হাওদে কাওসারের পানি থেকে বিতাড়িত হবে।

গ. ইমাম আবু দাউদ  সাবিত বিন দাহহাক থেকে বর্ণনা করেছেন: "রাসূল (স.) এর যুগে এক ব্যক্তি বুওয়ানাহ নামক জায়গায় একটি উট জবাই করার জন্য মানত করেছিলো। অতঃপর সে আল্লাহর নবীর কাছে এসে বললো: আমি বুওয়ানাতে একটি উট জবাই করার মানত করেছি। তখন রাসূল (স.) তাকে বললেন: সেখানে কি কোন  জাহিলিয়্যাতের মুর্তির পূজা হয়? সাহাবাগণ বললেন: না। রাসুল (স.) আবার বললেন:  ঐ জায়গায় কি মুশরিকদের কোন উৎসব হয়? সাহাবাগণ বললেন: না। তখন রাসূল (স.) বললেন: তাহলে তোমার নাযর/মানত পূর্ণ করো। (জেনে রেখো) আল্লাহর নাফরমানির ব্যাপারে মানত করলে কিংবা যে মানুষের মালিকানাধীন নয়; এমন ব্যাপারে মানত করলে তা পূর্ণ করা যাবে না”। 

এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুশরিকদের মুর্তিপূজার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করাতো দূরের কথা, তারা যে দিন ও স্থানকে সম্মান করে সেগুলোকে সম্মান করা, এমনকি সেখানে গিয়ে মানত পূর্ণ করাও মুসলিমদের জন্য বৈধ নয়।

ঘ. ‘উমার (রা.) বলেছেন: “তোমরা মুশরিক/মূর্তিপূজারীদের উৎসবের দিনে তাদের উপাসনালয়ে প্রবেশ করবে না; কারণ তখন তাদের উপর আল্লাহ ক্রোধ/গযব নাযিল হতে থাকে। (ইমাম বায়হাকী বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেছেন)। 

ঙ. হযরত আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর বিন ‘আস (রা.) বলেছেন: “যারা মুশরিকদের ভূমিতে নির্মাণ করবে, তাদের মত উৎসব-অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাদের সাথে (ইসলাম পরিপন্থী কাজে) তাদের সাথে সামঞ্জস্য রাখবে, তারাই পরকালে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যাবে”।

চ. হযরত ‘উমার (রা.) সিরিয়ার খ্রীষ্টানদের সাথে যে সন্ধি চুক্তি করেছিলেন, তাতে যে সব শর্ত আরোপ করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে এ কথাও ছিলো: “আহলুযযিম্মাহ (খ্রীষ্টানগণ) মুসলিমদের বাজর-ঘাট অর্থাৎ স্থানে তাদের ক্রশ এবং কোন ধর্মীয় বই-পুস্তক (গীর্জার) বাহিরে আনতে পারবেনা। তারা তাদের ঈদ-উৎসব প্রকাশ্যে সাধারণ জায়গায় পালন করতে পারবে না। (বায়হাকী)।

এর থেকে প্রমাণিত হয়, অমুসলিমগণ ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের ঈদ-উৎসব ও একন্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিগুলো তাদের উপসনালয়ে পালন করতে পারবে। সাধারণ সব জায়গায় পারবে না। যাতে করে তাদের কুফরির নাপাকি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে না পারে।

ছ. তাছাড়া, মদীনায় ইয়াহুদীরা বসবাস করতো। তারা তাদের উৎসাবাদিও পালন করতো। কিন্তু কোন সাহাবী তাতে অংশ গ্রহণ করেছেন, এ রকম একটি বর্ণনাও নেই। বরং তাঁরা তাদের এই সব শিরকমূলক কর্মকান্ড ঘৃণা করতেন।

জ. আমাদের উচিত, আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়াহ করা। তিনি দয়া করে আমাদেরকে মুসলিম বানিয়েছেন। হিদায়াত দান করেছেন। আমরা ঘোষণা করেছি: “আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে এবং মুহাম্মাদ (স.) কে নবী হিসেবে পেয়ে আমরা খুশী হয়েছি।” সুতরাং আমরা কী করে শিরকের অভিশাপের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারি? যে শিরক থেকে মাবতাকে মুক্তি দিতেই আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। যে শিরকের প্রতি ঘৃণা ব্যক্ত করে স্বয়ং আল্লাহ বলছেন: “ওরা কি আল্লাহর সাথে এমন বস্তুকে শরীক স্থাপন করছে, যা কিছু সৃষ্টি করতে পারে না; ওদেরকেই বরং সৃষ্টি করা হয়েছে”। (আল-‘আরাফ: ১৯১)

“আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল কিম্বা বাতাস তাকে দূরের কোন জায়গায় নিক্ষেপ করল”। (সূরা আল-হাজ্জ: ৩১)

মূর্তিপূজা মূলত শয়তানের পূজা। এ জন্যই ইব্রাহীম (আ.) তাঁর বাবাকে বলেছিলেন: “হে বাবা! তুমি শয়তানের পূজা করো না”। [সূরা মারইয়াম: ৪৪]

মনে রাখতে হবে: আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, আমরা যেন কাফিরদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে তাদের মত না হয়ে যাই। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, “আহলে কিতাবের অনেকেই চায়, যদি তারা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর কাফির অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারত! সত্য স্পষ্ট হওয়ার পর তাদের পক্ষ থেকে হিংসাবশত (তারা) এরূপ করে থাকে। (সূরা আল-বাকারাহ:১০৯)

প্রখ্যাত মনীষী ইবনুল কায়্যীম (র.) বলেন: “কুফরীর সাথে একান্তভাবে সম্পৃক্ত কাফিরদের পরিচয়দায়ক বিষয়ে তাদেরকে শুভেচ্ছা জানানো আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে হারাম”।

*তৃতীয়ত: বুদ্ধিবৃত্তিক দলীল:*

অমুসলিমদের জীবনাচার ও বিশ্বাসের প্রতি আসক্তি ও সামঞ্জস্য  মুসলিমদেরকে ধ্বংস করে দেয়। পরিণামে মুসলিম উম্মাহ তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, মৌলবিশ্বাস, জীবনাচার ও আত্মবোধের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ে। এর আধুনিক নাম “বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ”। এই যুদ্ধে পরাজিত হলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। এইতো সে দিন একজন এম পি স্কুলের কোমলমতি হিজাব পরিহিতা ছাত্রীদের কে দিয়ে সংবর্ধনার নামে এক প্রকার হিন্দুধর্মীয় পূজার মহড়া করালেন। চেতনার এই বিকৃতিবোধ এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। অমুসলিমদের জীবনাচার ও বিশ্বাস যেন মুসলিমদের মাঝে কোনভাবেই অনুপ্রবেশ করছে না সে জন্য তিন সময় নামায পড়া হারাম করা হয়েছে। জাহেলীযুগের দুই দিন পরিবর্তন করে অন্য দুই দিনে মুসলমানদের জন্য ঈদের প্রবর্তন করা হয়েছে। যাতে করে সময়গত সামঞ্জস্যও না পাওয়া যায়। সেথায় মূর্তিপুজার আয়োজনে মুসলিমরা যোগ দেবে ! এটা কি কল্পনা করা যায়?

অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে তাদের ধর্মীয় চালচলনের মধ্যে একাকার হয়ে যাওয়ার নাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নয়; বরং এর নাম হচ্ছে আত্মহনন। এটা কিন্তু মুসলিম নামধারী কিছু তথাকথিত পরজীবি বুদ্ধিজীবি ছাড়া অন্য কেউ বলে না। 
“ধর্ম যার যার উৎসব সবার” এ কথা স্বয়ং অমুসলিমরাও বলে না। কারণ, তাহলে তাদেরকে আমাদের সাথে কুরবানীর গরু জবাই করতে হবে। ইসলাম অমুসলিমদের ধর্মগুলোকে সত্য মনে করে না। তবুও তাদেরকে দিয়েছে ধর্মীয় স্বাধীনতা। তাদেরকে জোরপূর্বক মুসলিম বানাবার অনুমতি দেয়নি। এমন কি তাদের দেবদেবীকে গালি দিতেও নিষেধ করেছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করার শিক্ষা দিয়েছে। তাদের জান-মালের পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা দিয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদেরকে নিবিঘ্নে তাদের ধর্মচর্চার জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে। নিম্নোক্ত আয়াত এবং হাদীসুগলোই এই সত্য অনুধাবনের জন্য যথেষ্ট:

ক. “(আল্লাহর) দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর জবরদস্তি নেই। (অর্থাৎ জোর করে কোন অমুসলিমকে মুসলিম বানানোা যাবে না)। (আল্-বাকারাহ:২৫৬)।
.
“হে রাসূল তুমি বলে দাও, সত্য তোমাদের রবের কাছ থেকে সমাগত। অতএব, যার ইচ্ছা সে ঈমান গ্রহণ করুক। যার ইচ্ছা সে অস্বীকার/কুফরা করুক। “ (আল- কাহফ: ২৯)

“তোমার রব যদি ইচ্ছা করতেন তাহলে পৃথিবীর সবাই ঈমানদার হয়ে যেত। তুমি কি লোকদের জোর জবরদস্তি করবে যাতে তারা সবাই মুমিন হয়ে যায়”? (ইউনূস: ৯৯)।

“যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে কখনো ) করছে, তোমরা তাদেরকে গালি দিও না, তাহলে তারা অজ্ঞতা বশত শত্রুতামূলক ভাবে আল্লাহকে  গালি দিবে”। (আল আন‘আম: ১০৮)

“যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে কখনো যুদ্ধ করেনি এবং কখনো তোমাদের নিজেদের বাড়িঘর থেকেও বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি দয়া দেখাতে ও তাদের সাথে ন্যায় আচরণ করতে আল্লাহ কখনো নিষেধ করেন না। অবশ্যিই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন”। (আল মুমতাহিনা: ৯)

“হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (স.) যখন ইন্তেকাল করেছিলেন, তখন তাঁর বর্মটি ত্রিশ সা‘ যব ঋণ নেয়ার কারণে এক ইয়াহুদীর কাছে  বন্ধক ছিলো”।

“হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (স.) কে এক ইয়াহুদী যুবক খিদমাত করতো। যুবকটি অসুস্থ হয়ে পড়লে রাসূল (স.) তাকে দেখতে যান এবং তার শিওরের পাশে বসেন। তারপর বলেন, হে যুবক ইসলাম গ্রহণ করো। যুবক তখন তার বাবার দিকে তাকাতে লাগলো। সে তার মাথার পাশেই ছিল। বাবা তখন তাকে বললেন, বৎস, তুমি আবুল কাসিম (রাসূল) যা বলছেন, তা ই করো। অতঃপর ছেলেটি ইসলাম গ্রহণ করে। নবী (স.) তারপর চলে যান এবং বলেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি ছেলেটিকে জাহান্নামের আগুন থেকে উদ্ধার করেছেন” (বুখারী)।

অতএব, তাদের পূজায় না গেলেই যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়ে যাবে কিংবা গেলেই তা বেড়ে যাবে, এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অমূলক চিন্তা। বরং এ জাতীয় কর্ম একদিকে যেমন আমাদের ঈমান ধ্বংস করে আমাদের কে মুশরিক বানিয়ে দেয়, কারণ, যেমন ধরুন, দূর্গা পূজার উৎসবে যোগদান মানেই হলো, দূর্গার প্রতি বিশ্বাস করা। প্রত্যক্ষভাবে হোক বা পরোক্ষভাবে হোক। এই পরোক্ষ ফল হয়ত বিলম্বেও হতে পারে। অন্যদিকে, এর মাধ্যমে সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। আর যেখানে সম্প্রদায়ই থাকে না, সেখানে সম্প্রীতি কোথায় থাকে?

বাস্তবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অর্থ হলো:

প্রত্যেক সম্প্রদায় ও ধর্মাবলম্বীগণ কর্তৃক নিজ নিজ বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠানে স্বাতন্ত্র্য লালন করা এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। পক্ষান্তরে, পরস্পর ধর্মীয় বিশ্বাস-আক্কীদায় হারিয়ে যাওয়াটা হবে এ রকম: “বিয়ে যার যার, বৌ সবার”। হ্যা, যদি কেউ নিজ ধর্ম ছেড়ে ইসলামে আসতে চায়, ইসলাম তাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু আসতে হবে পূর্ণাঙ্গভাবে। ইসলাম থেকে কিছু আবার শিরক থেকে, কিছু কিংবা মানুষের বানানো আইন থেকে, কিছু এ জাতীয় খিচুরী মার্কা আকবরের দ্বীনে ইলাহীর স্থান ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের ডিকশোনারিতে থাকতে পারে, ইসলামে নেই। মক্কার মুশরিকরাও এটা চেয়েছিল। বলেছিল, মুহাম্মাদ! এসো আমরা মিলে মিশে (আধুনকি ভাষায়: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে) সহাবস্থান করি। কিছুদিন তুমি আমাদের মূর্তির পূজা করবে, আর কিছু দিন আমরা তোমার ইলাহের পূজা করবো!! কিন্তু এই প্রেক্ষিতে তাওহীদ এবং শিরক কখনো একত্রিত হতে পারে না, এই মহাসত্য নিয়ে নাযিল হলো সূরা কাফিরুন। মনে রাখতে হবে, ইসলামে প্রবেশের দুয়ার সকলের জন্য উম্মুক্ত। কিন্তু ইসলাম থেকে চলে যাওয়ার পথ চিররুদ্ধ। এটাই ইসলামে ধর্মীয় স্বাধীনতা। 

*উপসংহার:*

হাদিসে এসেছে, "যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে।" (সুনানে আবু দাউদ, ৪০৩১)

অন্য একটি বর্ণনায় খলীফা হযরত উমর রা. বলেছেন,  "তোমরা আল্লাহর দুশমনদের উৎসবগুলোতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাক।" (আসসুনানুল কুবরা, ১৮৮৬২)

অন্য বর্ণনায় তিনি এর ব্যাখ্যায় বলেছেন ‘কারণ এক্ষেত্রে আল্লাহর অসন্তুষ্টি নাযিল হয়ে থাকে।’ আরেকটি বর্ণনায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেছেন, "যারা বিধর্মীদের মত উৎসব করবে, কিয়ামত দিবসে তাদের হাশর ঐ লোকদের সাথেই হবে।" (আসসুনানুল কুবরা, ১৫৫৬৩)

তবে এক ধর্মের সাথে অপর ধর্মের অনুসারীদের সহাবস্থান এবং অন্য ধর্মের অনুসারীদের আপন আপন পূজা-আরাধনা নির্বিঘ্নে পালন করতে সহযোগিতার বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত পরিষ্কার। ইসলাম এতে পূর্ণ সমর্থন দেয় ও দায়িত্ব গ্রহণ করে।

ইসলামের স্পষ্ট নীতি হচ্ছে, যে কোনো ধর্মাবলম্বী নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে তার ধর্ম পালন করুক। নিজস্ব পরিধির মধ্যে তার ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা তার রয়েছে। ইসলাম এক্ষেত্রে কোনো প্রকার অসহযোগিতা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। বরং তাদের নিজস্ব গণ্ডির ভেতরে থেকে এগুলো পালন করার জন্য ইসলামী সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও দেয়া হয়েছে ইসলামী খেলাফতের সময়গুলোতে। হযরত উমর রা. তাঁর শাসনামলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের كنيسة (কানীসা) বানানোর সুযোগও দিয়েছেন। সুতরাং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার এবং ধর্মীয় আচার-আচরণকে এক করে দেখার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, প্রত্যেক ধর্মের নিজস্ব। এ উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব ও আনন্দও তাদের নিজস্ব। কিন্তু, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অন্যদের ধর্মীয় কাজে যোগ দেওয়া, সেগুলোকে পছন্দ করা, সে উৎসবকে নিজের উৎসব মনে করার কোনো একটি বিষয়ই শরীয়ত কর্তৃক সমর্থিত নয়। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝার এবং সে অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন। (আমীন)
Read More

ইসলামে অপচয় এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ

ইসলামে অপচয় এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ

অপচয় ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। হালাল কাজে চাহিদার বেশি খরচ করাকে অপচয় বলা হয়। যা কুরআনের ভাষায় ‘ইসরাফ’ বলা হয়। তাইতো কুরআনে অপচয়কে শয়তানের কাজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

মানুষের জীবনধারণ, খাবার ও নানাবিধ প্রয়োজন পূরণে জন্য যেসব উপাদান প্রয়োজন, তার সবই বিশ্বপ্রকৃতিতে আল্লাহতায়ালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এগুলো উপার্জন সাপেক্ষ, মেহনতের সাহায্যে ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে হয়। যেমন জমি ও জন্তু-জানোয়ার। এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্বমানবতার জন্য নিয়ামত। তবে এসবের একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ নিজে। দুনিয়ার মানুষ নিজেদের ভোগ-বিলাস ও ফায়দা হাসিলের জন্য এগুলো ব্যবহার করার অধিকার পেয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য আল্লাহতায়ালা এগুলো দান করেছেন। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সবই তোমাদেরই কল্যাণ বা প্রয়োজন পূরণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (সুরা বাকারা, ২৯)

আল্লাহতায়ালা মানুষকে তার দয়ার অপার মহিমায় ভোগ-বিলাসের জন্য এসব নিয়ামত দান করেছেন। তাই বলে এসবের অপচয় ও ধ্বংস করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এ নিয়ামতগুলোর অপচয় ও ধ্বংস আজ ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে চলছে ব্যাপকহারে। মাটির নিচে আল্লাহতায়ালা দান করেছেন অফুরন্ত খনিজসম্পদ যা আমাদের জাতীয় সম্পদ। কিন্তু ব্যক্তি ও জাতীয় পর্যায়ে এ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও সংরক্ষণ কোনোটিই সঠিকভাবে হচ্ছে না। অযত্ন, অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে আল্লাহর এ নিয়ামতের আমানতদারিতার সুস্পষ্ট খেয়ানত হচ্ছে।

আল্লাহতায়ালার কাছে অফুরন্ত ও অসীম সম্পদের ভাণ্ডার রয়েছে। সর্বোপরি তিনি যখন যা ‘হও’ বলেন, তা হয়ে যায়। কমতি, সীমাবদ্ধতা, সংকীর্ণতা ও অভাব কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তদুপরি তিনি মানুষকে সম্পদ দানের পর আবার এর অপচয়ের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করলেন কেন? প্রকৃতপক্ষে মানুষকে একটি নিয়ম-শৃঙ্খলার আওতায় এনে জীবনকে সার্থক করে গড়ে তোলাই এর লক্ষ্য। কারণ লাগামহীন জীবনযাপন শয়তানের বৈশিষ্ট্য। শয়তানের কাছে ধরাবাঁধা নিয়ম-শৃঙ্খলা সহনীয় নয়। আর অপচয়, ভাঙন ও ধ্বংস শয়তানের কাজ। তাই অপচয় ও ধ্বংসাত্মক কাজ শয়তান ব্যতিরেকে কোনো মানুষের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।

এমনিভাবে জাতীয় সম্পদের আমানতদার রাষ্ট্রের শাসকরা। তাদের অবহেলা ও ভুল সিদ্ধান্তের জন্য কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। কিন্তু আল্লাহর এ আমানত খেয়ানত করার অধিকার আল্লাহ তাদের দেননি। আল্লাহর কাছে তাদের অবশ্যই এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কারণ আল্লাহর এসব নিয়ামত সংরক্ষণের দায়িত্ব খোদ সরকারের।

আল্লাহতায়ালা তার অফুরন্ত ভাণ্ডার মানুষের জন্য খুলে দিতে চান। কিন্তু মানুষ যদি ক্রমাগত তাদের অযোগ্যতা, অসতর্কতা ও অদক্ষতার প্রদর্শন করতে থাকে এবং সম্পদকে বিভিন্নভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে থাকে তবে এটাকে আল্লাহতায়ালার প্রতি এক ধরনের অকৃতজ্ঞতা বলা যায়। এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাদের পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তাতেই তোমাদের জন্য জীবিকা-নির্বাহের যাবতীয় উপাদান সৃষ্টি করেছি কিন্তু তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞ।’ (সুরা আরাফ, ১০)

প্রকৃতির মধ্যে মানুষ এবং জন্তু-জানোয়ারের জন্য উদ্ভিদের চেয়ে পরম বন্ধু আর কিছু নেই। কেননা উদ্ভিদ শুধু মানুষের খাবার জোগায় না বরং বায়ু থেকে বিষাক্ত গ্যাস কার্বন-ডাই অক্সাইড শুষে নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন তৈরি করে। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর তিনি জমিনকে বিস্তার করে দিয়েছেন। আর তা থেকে পানি ও তরুলতাদি নির্গত করেছেন এবং পাহাড়কে তিনিই সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর তা (গাছ-গাছড়া) হলো তোমাদের এবং তোমাদের জন্তু-জানোয়ারদের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ।’ (সুরা আন নাযিয়াত, ৩০-৩৩)

কাজেই উদ্ভিদ বিশ্ববাসীর জন্য সাধারণ কোনো কিছু নয় বরং মহামূল্যবান সম্পদ। কোরআনে কারিমে অসংখ্যবার আল্লাহতায়ালা উদ্ভিদরূপ নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ অপরিণামদর্শী মানুষ বিনাপ্রয়োজনে বনের পর বন উজাড় করে চলছে। সেই সঙ্গে পাহাড় কেটে ও নদী-নালা ভরাট করছে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

একদা এক অভিযানকালে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) সৈন্যদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। (তখন) তিনি দেখতে পেলেন, কোনো কোনো সাহাবি হাতের অস্ত্রের আঘাতে পরিপার্শ্বস্থ গাছের ডালপালা কাটছেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের নিষেধ করলেন, আর বললেন, ‘খবরদার! অযথা তোমরা গাছপালার ওপরে আঘাত কোরো না। কেননা তাদের প্রাণ আছে তোমাদের আঘাতে তারা কষ্ট পায় ও কাঁদে।’

অপচয় একটি গর্হিত কাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য তিনটি বস্তু অপছন্দ করেন- ১. অনর্থক এবং বাজে কথা বলা, ২. নিষ্প্রয়োজনে মাল নষ্ট করা এবং ৩. অত্যধিক প্রশ্ন করা।’ (বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, আবূ দাউদ, আহমাদ, দারেমী)

ক. পানির অপচয়- বিনা প্রয়োজনে পানি ব্যয় করা অন্যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তুমি যদি সাগরপাড়ে বসেও পানি অতিরিক্ত ব্যবহার করো, তাও অপচয় হবে।

খ. খাওয়া দাওয়া- প্লেটে খাবার নিয়ে ফ্যাশন বা সৌজন্যবোধ মনে করে ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার না খাওয়া। আল্লাহ কুরআনে এরশাদ করেন, ‘এবং তোমরা আহার করো ও পান করো। কিন্তু অপচয় করো না। তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা আ’রাফ, ৩১)

গ. গ্যাসের অপচয়- গ্যাসের মিটার পদ্ধতি না থাকায় দেশের সবচেয়ে বেশি অপচয় হচ্ছে গ্যাস। মাসভিত্তিক বিলের কারণে এ অপচয়ের মাত্রা মহামারীর আকার ধারন করেছে। মনে রাখতে হবে, গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদ, বান্দার জন্য অল্লাহর অপার অনুগ্রহ।

ব্যক্তি পর্যায়ে দেখা যায়, বাসাবাড়িতে অনর্থক গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখা হয়। অমূল্য এ সম্পদ দিয়ে কাপড় শুকানো হয়। এমনকি একটি ম্যাচের শলাকা খরচ না করার জন্য গ্যাসের চুলা দীর্ঘক্ষণ নেভানো হয় না। এগুলো সুস্পষ্ট অপচয়। অপচয় বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘(ধন-সম্পদের) অপচয় করো না, যারা এভাবে ধন-সম্পদের অপচয় করে তারা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ।’(সুরা বনি ইসরাইল, ২৬-২৭)

ঘ. বিদ্যুতের অপচয় : লোডশেডিংয়ের মাঝেও আমরা বিদ্যুতের মারাত্মক অপচয় করি। বিশেষ করে অফিস-আদালত, কোয়াটার, রাস্তা-ঘাট, টয়লেটসহ অপ্রয়োজনীয় স্থানে সবসময় বিদ্যুতের অপচয় হয়। বিশেষ করে কোনো দিবস বা অনুষ্ঠান হলে আলোকসজ্জা, লাইটিংয়ের নামে বিদ্যুতের অপচয় আমাদের জাতীয় জীবনে বিদ্যৎ সংকট মহামারীর আকার ধারণ করেছে। যা রোধ করা সবার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।

ঙ. সাজসজ্জা ও সৌন্দয্যবর্ধন- শারিরীক সৌন্দর্য বর্ধনে পোশাকের নামে আমরা যে সব পোশাক ক্রয় করে থাকি, তার ক্ষতির দিকগুলোই বেশি। একদিকে যেমন আর্থিক অপচয়, অন্যদিকে আল্লাহর বিধানের লংঘন। আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত বিষয়গুলো না ভেবে বেশি দামে পোশাক ও প্রসাধনী ক্রয়ে প্রতিযোগিতাও সীমাহীন অপচয় হয়। যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

এখানে শুধুমাত্র সামান্য কয়েকটি নিয়ামতের কথা উল্লেখ করা হলো। এছাড়াও মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে আল্লাহর দেওয়া অসংখ্য নিয়ামত ভোগ করছেন। এগুলোরও সুষম ব্যবহার কাম্য। সুতরাং আমাদের উচিত মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা। অপচয়ের বিষয়ে আমাদের করণীয় কি হবে তা আল্লাহ তাআলা কুরআনে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপচয় করে না, কাপর্ণ্যও করে না বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়।’ (সূরা ফুরকান, ৬৭)।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সমস্ত ধরনের অপচয় করা থেকে হেফাজত করুন। (আমীন)

Read More

আল কুরআনের হক

আল কুরআনের হক


আল-কুরআনের হক

কুরআনুল কারীম বিশ্ব মানবতার জন্য এক অফুরন্ত নিয়ামাত। আল্লাহ তাআলার বড়ই মেহেরবানী যে, তিনি আমাদের উপর কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿ٱلرَّحۡمَٰنُ ١ عَلَّمَ ٱلۡقُرۡءَانَ ٢﴾ [الرحمن: ١، ٢]

বড়ই মেহেরবান তিনি (আল্লাহ) কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন’ -[সূরা  আর-রহমান : ১-২]।

কুরআন এমন একটি কিতাব যার মাধ্যমে আরবের সেই বর্বর জাতি সৌভাগ্যবান জাতিতে পরিণত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন দিয়েই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ তৈরি করেছিলেন। তিনি বলেছেন,

«خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي».

বিশ্বমানবমন্ডলীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো আমার যুগ’ -[সহীহ বুখারী : ২৬৫২]।

কুরআন মাজীদের বেশ কিছু হক রয়েছে যেগুলো আদায় করা আবশ্যক।  এর অনেকগুলো হক এমন  যে, কেউ যদি তা আদায় না করে কিয়ামাতের দিন নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ করবেন। কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿وَقَالَ ٱلرَّسُولُ يَٰرَبِّ إِنَّ قَوۡمِي ٱتَّخَذُواْ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ مَهۡجُورٗا ٣٠﴾ [الفرقان: ٣٠]

আর রাসূল বলবেন (কিয়ামাতে), ‘‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার জাতি এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে’’ -[সূরা আল-ফুরকান : ৩০]।

আমাদের উপর কুরআনের যে হকগুলো রয়েছে তা এখানে আলোচনা করা হলো :

ঈমান আনা  

কুরআনের হকসমূহের মধ্যে প্রধানতম হক বা অধিকার হলো কুরআনের প্রতি ঈমান আনা। কুরআনের প্রতি ঈমান আনার অর্থ হলো : কুরআন আল্লাহর কালাম, ইহা আসমানী শেষ কিতাব এবং এই কিতাবের মধ্য দিয়ে সকল আসমানী কিতাব রহিত হয়ে গিয়েছে। কুরআন বিশ্ব মানবমন্ডলীর জন্য হিদায়াত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর বা আলো। কুরআনে এসেছে,

﴿فَ‍َٔامِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَٱلنُّورِ ٱلَّذِيٓ أَنزَلۡنَاۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرٞ ٨﴾ [التغابن: ٨]

অতএব তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এবং আমি যে নূর অবতীর্ণ করেছি তার প্রতি ঈমান আন। আর তোমরা যে আমল করছ আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত’ -[সূরা আত-তাগাবুন : ০৮]।

﴿أَفَتُؤۡمِنُونَ بِبَعۡضِ ٱلۡكِتَٰبِ وَتَكۡفُرُونَ بِبَعۡضٖۚ فَمَا جَزَآءُ مَن يَفۡعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمۡ إِلَّا خِزۡيٞ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰٓ أَشَدِّ ٱلۡعَذَابِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٨٥﴾ [البقرة: ٨٥]

তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর, সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্চনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে! আর কিয়ামাতের দিন তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর, আর আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন’ -[সূরা আল-বাকারাহ : ৮৫]।

সহীহভাবে পড়তে জানা

কুরআন শিক্ষা করা ফরয করা হয়েছে। প্রত্যেক মুসলিমকে কুরআন পড়া জানতে হবে। কেননা কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿ٱقۡرَأۡ بِٱسۡمِ رَبِّكَ ٱلَّذِي خَلَقَ ١﴾ [العلق: ١]

পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ [সূরাহ আলাক : ১]। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন শিক্ষার নির্দেশ দিয়ে বলেন,

«تَعَلَّمُوا الْقُرْآنَ ، وَاتْلُوهُ»

তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং তা তিলাওয়াত কর’ [মুসনাদ আল-জামি‘ : ৯৮৯০]।

 

তিলাওয়াত করা ও শুনা 

কুরআন তিলাওয়াত করা কুরআনের অন্যতম হক। কুরআন মাজীদে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এভাবে,

﴿ٱتۡلُ مَآ أُوحِيَ إِلَيۡكَ مِنَ ٱلۡكِتَٰبِ﴾ [العنكبوت: ٤٥]

তোমার প্রতি যে কিতাব ওহী করা হয়েছে, তা থেকে তিলাওয়াত কর’ -[সূরাহ আনকাবুত : ৪৫]।

সহীহভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে। তিলাওয়াতের আদবগুলো রক্ষা করতে হবে। বাংলাভাষায় উচ্চারণ করে পড়লে হবে না।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : « لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بِالْقُرْآنِ»

আবূ হুরায়রা রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে কুরআন সুন্দর উচ্চারণে পড়ে না, সে আমার উম্মতের মধ্যে শামিল নয়’ -[সহীহ বুখারী : ৭৫২৭]।
ধীরস্থীরভাবে তিলাওয়াত করার নির্দেশ দিয়ে কুরআনে বলা হয়েছে।

﴿وَرَتِّلِ ٱلۡقُرۡءَانَ تَرۡتِيلًا ٤﴾ [المزمل: ٤]

 ‘তুমি কুরআনকে তারতীলের সাথে  অর্থাৎ ধীরস্থীরভাবে তিলাওয়াত কর’ -[সূরা আল-মুযযাম্মিল : ৪]।

আর কুরআন তিলাওয়াতে রয়েছে বিরাট সাওয়াব। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا ، لاَ أَقُولُ الْم حَرْفٌ ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلاَمٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ »

যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ’ -[সুনান আত-তিরমিযি : ২৯১০]।

কুরআন তিলাওয়াত শুনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাদীসে এসেছে

عَنْ عَبْدِ اللهِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ لِي النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «اقْرَأْ عَلَيَّ الْقُرْآنَ قُلْتُ آقْرَأُ عَلَيْكَ وَعَلَيْكَ أُنْزِلَ قَالَ إِنِّي أُحِبُّ أَنْ أَسْمَعَهُ مِنْ غَيْرِي»

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদি আল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘তুমি আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও, আমি বললাম, আপনার উপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, আমি আপনাকে কীভাবে কুরআন শুনাবো? তখন তিনি বললেন, আমি অপরের নিকট থেকে কুরআন শুনতে ভালবাসি’ -[সহীহ বুখারী : ৫০৪৯]।

 

অপরকে শিক্ষা দেয়া

কুরআনের অন্যতম হক হলো তা অপরকে শিক্ষা দেয়া। আমাদের প্রিয় নবীর অন্যতম কাজ ছিল মানুষকে কুরআন শিক্ষা দেয়া। আল-কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿لَقَدۡ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ بَعَثَ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡ أَنفُسِهِمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ١٦٤﴾ [آل عمران: ١٦٤]

‘‘অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল’’-[সূরা আলে ইমরান : ১৬৪]। কুরআন শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عُثْمَانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ« خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ»

উসমান রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে  কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়’-[সহীহ বুখারী : ৫০২৭]। যদি কেউ অপরকে কুরআন শিক্ষা দেয়, তবে তাঁর জন্য শিক্ষাগ্রহণকারীর সমান সাওয়াবের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। হাদীসে এসেছে,

«الْدَّال عَلَى الْخَيْر كَفَاعِلِه»

‘‘ভাল কাজের পথপ্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারী অনুরুপ সাওয়াব পাবে’’ -[সুনান আত-তিরমীযি : ২৬৭০]।

হিফয বা মুখস্থ করা

কুরআন হিফয করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা আল্লাহ তাআলা নিজেই কুরআন হিফযের দায়িত্ব নিয়েছেন। এ হিফযেরই এক প্রকার হচ্ছে, বান্দাদেরকে কুরআন হিফয করানোযার মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা তাঁর কুরআনকে সংরক্ষণ করেছেনকুরআনে এসেছে,

﴿إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩﴾ [الحجر: ٩]

‘‘নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি, আর আমিই তার হিফাযতকারী’’ -[সূরা আল-হিজর : ০৯]।

যে যত বেশি অংশ হিফয করতে পারবে তা তার জন্য ততই উত্তম। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু  আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِى الدُّنْيَا فَإِنَّ مَنْزِلَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَؤُهَا »

 

‘‘ কুরআনের হাফেযকে বলা হবে কুরআন পড়ে যাও, আর উপরে উঠতে থাক, ধীর-স্থিরভাবে তারতীলের সাথে পাঠ কর, যেমন দুনিয়াতে তারতীলের সাথে পাঠ করতে। কেননা জান্নাতে তোমার অবস্থান সেখানেই হবে, যেখানে তোমার আয়াত পড়া শেষ হয়’’ -[সুনান আত-তিরমিযী : ২৯১৪]।

বুঝা ও উপলব্ধি করা

কুরআনের অর্থ বুঝা ও অনুধাবন করা কুরআনের অন্যতম হক। কুরআনের অর্থ না বুঝতে পারলে কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য ও দাবী আমরা কেউ পালন করতে পারবো না। না বুঝে পড়লে কুরআনের আসল মজা পাওয়া যাবে না। কুরআন বুঝার জন্য শব্দের অর্থ, আয়াতের ব্যাখ্যা, অবতীর্ণ হওয়ার কারণ বা প্রেক্ষাপট এবং কুরআনের আয়াতসমূহের শিক্ষা জানতে হবে। কুরআনে এসেছে,

﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ قُرۡءَٰنًا عَرَبِيّٗا لَّعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ٢﴾ [يوسف: ٢]

‘‘নিশ্চয় আমি একে আরবী কুরআনরূপে নাযিল করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পার’’-[সূরা ইউসুফ: ০২]। কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে হাদীসের সাহায্য না নিলে যে কেউ বিভ্রান্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে হাদীসের সাহায্য নিলেই কেবল সহীহভাবে কুরআন বুঝা সম্ভব। আল-কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ﴾ [الحشر: ٧]

‘‘আর রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও’’-[সূরা আল-হাশর: ৭]। কুরআন বুঝার পাশাপাশি তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।

﴿أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ أَمۡ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقۡفَالُهَآ ٢٤﴾ [محمد : ٢٤]

‘‘তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না ? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে’’- [সূরা মুহাম্মাদ : ২৪]।

 

আমল করা

কুরআনের আমল করার অর্থ, কুরআনের অনুসরণ করা। কুরআন অনুযায়ী নিজের জীবনকে গড়ে তোলা। এ বিষয়ে কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে,

﴿ٱتَّبِعُواْ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكُم مِّن رَّبِّكُمۡ وَلَا تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَۗ قَلِيلٗا مَّا تَذَكَّرُونَ ٣﴾ [الأعراف: ٣]

তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর’ -[সূরা আল-আরাফ : ৩]।
কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন

«كُنَّا نَتَعَلَّمُ مِنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَشْرَ آيَاتٍ فَمَا نَعْلَمُ الْعَشْرَ الَّتِي بَعْدَهُنَّ حَتَّى نَتَعَلَّمَ مَا أُنْزِلَ فِي هَذِهِ الْعَشْرِ مِنَ الْعَمَلِ»

আমরা যখন নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে কুরআনের দশটি আয়াত শিক্ষা গ্রহণ করতাম, এরপর ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা পরবর্তী দশটি আয়াত শিক্ষা করতাম না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা এই দশ আয়াতের ইলম ও আমল শিখতাম’ -[শরহে মুশকিলুল আছার : ১৪৫০]।

যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেয়া

কুরআন মাজীদ সম্মানিত এবং যারা কুরআনের সাথে থাকবে তাঁরাও সম্মানের অধিকারী। এজন্য কুরআনের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। কুরআন তিলাওয়াতের সময় তাঁর হক আদায় করতে হবে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

﴿ٱلَّذِينَ ءَاتَيۡنَٰهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ يَتۡلُونَهُۥ حَقَّ تِلَاوَتِهِۦٓ أُوْلَٰٓئِكَ يُؤۡمِنُونَ بِهِۦۗ وَمَن يَكۡفُرۡ بِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ١٢١﴾ [البقرة: ١٢١]

যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তাঁরা তা পাঠ করে যথার্থভাবে। তাঁরাই তাঁর প্রতি ঈমান আনে। আর যে তা অস্বীকার করে, সে-ই ক্ষতিগ্রস্থ’ -[সূরা আল-বাকারাহ : ১২১]। কুরআনকে মহববত করা  আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে মহববত করার শামিল। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

«من أحبَّ القرآنَ أحبَّ اللهَ ورسولهَ»

যে কুরআনকে মহববত করল সে  যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে মহববত করল’-[জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ৩২৯]।

কুরআন প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা

কুরআনের প্রচার, প্রসার ও তা প্রতিষ্ঠার কাজ করা কুরআনের অন্যতম হক। নিজ ব্যবস্থাপনায় কুরআন শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন, কুরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতা, হিফয প্রতিযোগিতা, কুরআন বুঝার আসর, তাফসীর প্রতিযোগিতা, মাকতাব চালু করা, বিভিন্ন এলাকায় কুরআনের মুয়াল্লিম প্রেরণ বা মুয়াল্লিম স্পন্সর করা, কুরআন বিতরণ করা, কুরআনের মুয়াল্লিম তৈরি করা, কুরআনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত সংস্থাকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা, এ কাজের অন্তর্ভুক্ত। সর্বোপরি কুরআনের বিধান সমাজে প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,

﴿وَأَنۡ أَتۡلُوَاْ ٱلۡقُرۡءَانَۖ فَمَنِ ٱهۡتَدَىٰ فَإِنَّمَا يَهۡتَدِي لِنَفۡسِهِۦۖ وَمَن ضَلَّ فَقُلۡ إِنَّمَآ أَنَا۠ مِنَ ٱلۡمُنذِرِينَ ٩٢﴾ [النمل: ٩٢]

আর আমি যেন আল-কুরআন অধ্যয়ন করি, অতঃপর যে হিদায়াত লাভ করল সে নিজের জন্য হিদায়াত লাভ করল; আর যে পথভ্রষ্ঠ হল তাকে বল, আমিতো সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত’ -[সূরা আন-নামল : ৯২]।

﴿۞يَٰٓأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغۡ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ مِن رَّبِّكَۖ ﴾ [المائ‍دة: ٦٧]

হে রাসূল, তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও [সূরা আল-মায়িদাহ : ৬৭]। কুরআন তিলাওয়াত, হিফয, প্রচার, প্রসার এবং প্রতিষ্ঠার কাজে আনন্দ প্রকাশ করার সুযোগ রয়েছে। কুরআন এমন একটি কিতাব যা নিয়ে ঈমানদার বান্দাহগণ আনন্দ প্রকাশ করতে পারে। কেননা আল-কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡكُم مَّوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَآءٞ لِّمَا فِي ٱلصُّدُورِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ ٥٧ قُلۡ بِفَضۡلِ ٱللَّهِ وَبِرَحۡمَتِهِۦ فَبِذَٰلِكَ فَلۡيَفۡرَحُواْ هُوَ خَيۡرٞ مِّمَّا يَجۡمَعُونَ ٥٨﴾ [يونس: ٥٧،  ٥٨]

হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত। বল, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম’ -[সূরা ইউনুস : ৫৭-৫৮]। আবূ সাইদ খুদরী রাদি আল্লাহু আনহু বলেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ হলো আল-কুরআন এবং এর অধিকারী হওয়াই রহমত’ -[শুয়াবুল ঈমান]।

প্রিয় পাঠক!

আমরা কি কুরআনের হকগুলো আদায় করতে পারছি? আদায় করার জন্য কোন প্রচেষ্টা আছে কি? আসুন কুরআনের হকগুলো আদায় করি, কিয়ামাতের সেই ভয়াবহ দিনে কুরআনের সুপারিশ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরআনের হকগুলো যথাযথভাবে পালন করার তাওফীক দিন। আমীন!

﴿ٱلرَّحۡمَٰنُ ١ عَلَّمَ ٱلۡقُرۡءَانَ ٢﴾ [الرحمن: ١، ٢]

বড়ই মেহেরবান তিনি (আল্লাহ) কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন’ -[সূরা  আর-রহমান : ১-২]।

কুরআন এমন একটি কিতাব যার মাধ্যমে আরবের সেই বর্বর জাতি সৌভাগ্যবান জাতিতে পরিণত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন দিয়েই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ তৈরি করেছিলেন। তিনি বলেছেন,

«خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي».

বিশ্বমানবমন্ডলীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো আমার যুগ’ -[সহীহ বুখারী : ২৬৫২]।

কুরআন মাজীদের বেশ কিছু হক রয়েছে যেগুলো আদায় করা আবশ্যক।  এর অনেকগুলো হক এমন  যে, কেউ যদি তা আদায় না করে কিয়ামাতের দিন নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ করবেন। কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿وَقَالَ ٱلرَّسُولُ يَٰرَبِّ إِنَّ قَوۡمِي ٱتَّخَذُواْ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ مَهۡجُورٗا ٣٠﴾ [الفرقان: ٣٠]

আর রাসূল বলবেন (কিয়ামাতে), ‘‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার জাতি এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে’’ -[সূরা আল-ফুরকান : ৩০]।

আমাদের উপর কুরআনের যে হকগুলো রয়েছে তা এখানে আলোচনা করা হলো :

ঈমান আনা  

কুরআনের হকসমূহের মধ্যে প্রধানতম হক বা অধিকার হলো কুরআনের প্রতি ঈমান আনা। কুরআনের প্রতি ঈমান আনার অর্থ হলো : কুরআন আল্লাহর কালাম, ইহা আসমানী শেষ কিতাব এবং এই কিতাবের মধ্য দিয়ে সকল আসমানী কিতাব রহিত হয়ে গিয়েছে। কুরআন বিশ্ব মানবমন্ডলীর জন্য হিদায়াত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর বা আলো। কুরআনে এসেছে,

﴿فَ‍َٔامِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَٱلنُّورِ ٱلَّذِيٓ أَنزَلۡنَاۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرٞ ٨﴾ [التغابن: ٨]

অতএব তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এবং আমি যে নূর অবতীর্ণ করেছি তার প্রতি ঈমান আন। আর তোমরা যে আমল করছ আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত’ -[সূরা আত-তাগাবুন : ০৮]।

﴿أَفَتُؤۡمِنُونَ بِبَعۡضِ ٱلۡكِتَٰبِ وَتَكۡفُرُونَ بِبَعۡضٖۚ فَمَا جَزَآءُ مَن يَفۡعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمۡ إِلَّا خِزۡيٞ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰٓ أَشَدِّ ٱلۡعَذَابِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٨٥﴾ [البقرة: ٨٥]

তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর, সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্চনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে! আর কিয়ামাতের দিন তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর, আর আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন’ -[সূরা আল-বাকারাহ : ৮৫]।

সহীহভাবে পড়তে জানা

কুরআন শিক্ষা করা ফরয করা হয়েছে। প্রত্যেক মুসলিমকে কুরআন পড়া জানতে হবে। কেননা কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿ٱقۡرَأۡ بِٱسۡمِ رَبِّكَ ٱلَّذِي خَلَقَ ١﴾ [العلق: ١]

পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ [সূরাহ আলাক : ১]। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন শিক্ষার নির্দেশ দিয়ে বলেন,

«تَعَلَّمُوا الْقُرْآنَ ، وَاتْلُوهُ»

তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং তা তিলাওয়াত কর’ [মুসনাদ আল-জামি‘ : ৯৮৯০]।

 

তিলাওয়াত করা ও শুনা 

কুরআন তিলাওয়াত করা কুরআনের অন্যতম হক। কুরআন মাজীদে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এভাবে,

﴿ٱتۡلُ مَآ أُوحِيَ إِلَيۡكَ مِنَ ٱلۡكِتَٰبِ﴾ [العنكبوت: ٤٥]

তোমার প্রতি যে কিতাব ওহী করা হয়েছে, তা থেকে তিলাওয়াত কর’ -[সূরাহ আনকাবুত : ৪৫]।

সহীহভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে। তিলাওয়াতের আদবগুলো রক্ষা করতে হবে। বাংলাভাষায় উচ্চারণ করে পড়লে হবে না।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : « لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بِالْقُرْآنِ»

আবূ হুরায়রা রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে কুরআন সুন্দর উচ্চারণে পড়ে না, সে আমার উম্মতের মধ্যে শামিল নয়’ -[সহীহ বুখারী : ৭৫২৭]।
ধীরস্থীরভাবে তিলাওয়াত করার নির্দেশ দিয়ে কুরআনে বলা হয়েছে।

﴿وَرَتِّلِ ٱلۡقُرۡءَانَ تَرۡتِيلًا ٤﴾ [المزمل: ٤]

 ‘তুমি কুরআনকে তারতীলের সাথে  অর্থাৎ ধীরস্থীরভাবে তিলাওয়াত কর’ -[সূরা আল-মুযযাম্মিল : ৪]।

আর কুরআন তিলাওয়াতে রয়েছে বিরাট সাওয়াব। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا ، لاَ أَقُولُ الْم حَرْفٌ ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلاَمٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ »

যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ’ -[সুনান আত-তিরমিযি : ২৯১০]।

কুরআন তিলাওয়াত শুনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাদীসে এসেছে

عَنْ عَبْدِ اللهِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ لِي النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «اقْرَأْ عَلَيَّ الْقُرْآنَ قُلْتُ آقْرَأُ عَلَيْكَ وَعَلَيْكَ أُنْزِلَ قَالَ إِنِّي أُحِبُّ أَنْ أَسْمَعَهُ مِنْ غَيْرِي»

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদি আল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘তুমি আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও, আমি বললাম, আপনার উপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, আমি আপনাকে কীভাবে কুরআন শুনাবো? তখন তিনি বললেন, আমি অপরের নিকট থেকে কুরআন শুনতে ভালবাসি’ -[সহীহ বুখারী : ৫০৪৯]।

 

অপরকে শিক্ষা দেয়া

কুরআনের অন্যতম হক হলো তা অপরকে শিক্ষা দেয়া। আমাদের প্রিয় নবীর অন্যতম কাজ ছিল মানুষকে কুরআন শিক্ষা দেয়া। আল-কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿لَقَدۡ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ بَعَثَ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡ أَنفُسِهِمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ١٦٤﴾ [آل عمران: ١٦٤]

‘‘অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল’’-[সূরা আলে ইমরান : ১৬৪]। কুরআন শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عُثْمَانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ« خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ»

উসমান রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে  কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়’-[সহীহ বুখারী : ৫০২৭]। যদি কেউ অপরকে কুরআন শিক্ষা দেয়, তবে তাঁর জন্য শিক্ষাগ্রহণকারীর সমান সাওয়াবের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। হাদীসে এসেছে,

«الْدَّال عَلَى الْخَيْر كَفَاعِلِه»

‘‘ভাল কাজের পথপ্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারী অনুরুপ সাওয়াব পাবে’’ -[সুনান আত-তিরমীযি : ২৬৭০]।

হিফয বা মুখস্থ করা

কুরআন হিফয করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা আল্লাহ তাআলা নিজেই কুরআন হিফযের দায়িত্ব নিয়েছেন। এ হিফযেরই এক প্রকার হচ্ছে, বান্দাদেরকে কুরআন হিফয করানোযার মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা তাঁর কুরআনকে সংরক্ষণ করেছেনকুরআনে এসেছে,

﴿إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩﴾ [الحجر: ٩]

‘‘নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি, আর আমিই তার হিফাযতকারী’’ -[সূরা আল-হিজর : ০৯]।

যে যত বেশি অংশ হিফয করতে পারবে তা তার জন্য ততই উত্তম। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু  আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِى الدُّنْيَا فَإِنَّ مَنْزِلَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَؤُهَا »

 

‘‘ কুরআনের হাফেযকে বলা হবে কুরআন পড়ে যাও, আর উপরে উঠতে থাক, ধীর-স্থিরভাবে তারতীলের সাথে পাঠ কর, যেমন দুনিয়াতে তারতীলের সাথে পাঠ করতে। কেননা জান্নাতে তোমার অবস্থান সেখানেই হবে, যেখানে তোমার আয়াত পড়া শেষ হয়’’ -[সুনান আত-তিরমিযী : ২৯১৪]।

বুঝা ও উপলব্ধি করা

কুরআনের অর্থ বুঝা ও অনুধাবন করা কুরআনের অন্যতম হক। কুরআনের অর্থ না বুঝতে পারলে কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য ও দাবী আমরা কেউ পালন করতে পারবো না। না বুঝে পড়লে কুরআনের আসল মজা পাওয়া যাবে না। কুরআন বুঝার জন্য শব্দের অর্থ, আয়াতের ব্যাখ্যা, অবতীর্ণ হওয়ার কারণ বা প্রেক্ষাপট এবং কুরআনের আয়াতসমূহের শিক্ষা জানতে হবে। কুরআনে এসেছে,

﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ قُرۡءَٰنًا عَرَبِيّٗا لَّعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ٢﴾ [يوسف: ٢]

‘‘নিশ্চয় আমি একে আরবী কুরআনরূপে নাযিল করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পার’’-[সূরা ইউসুফ: ০২]। কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে হাদীসের সাহায্য না নিলে যে কেউ বিভ্রান্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে হাদীসের সাহায্য নিলেই কেবল সহীহভাবে কুরআন বুঝা সম্ভব। আল-কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ﴾ [الحشر: ٧]

‘‘আর রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও’’-[সূরা আল-হাশর: ৭]। কুরআন বুঝার পাশাপাশি তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।

﴿أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ أَمۡ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقۡفَالُهَآ ٢٤﴾ [محمد : ٢٤]

‘‘তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না ? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে’’- [সূরা মুহাম্মাদ : ২৪]।

 

আমল করা

কুরআনের আমল করার অর্থ, কুরআনের অনুসরণ করা। কুরআন অনুযায়ী নিজের জীবনকে গড়ে তোলা। এ বিষয়ে কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে,

﴿ٱتَّبِعُواْ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكُم مِّن رَّبِّكُمۡ وَلَا تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَۗ قَلِيلٗا مَّا تَذَكَّرُونَ ٣﴾ [الأعراف: ٣]

তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর’ -[সূরা আল-আরাফ : ৩]।
কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন

«كُنَّا نَتَعَلَّمُ مِنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَشْرَ آيَاتٍ فَمَا نَعْلَمُ الْعَشْرَ الَّتِي بَعْدَهُنَّ حَتَّى نَتَعَلَّمَ مَا أُنْزِلَ فِي هَذِهِ الْعَشْرِ مِنَ الْعَمَلِ»

আমরা যখন নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে কুরআনের দশটি আয়াত শিক্ষা গ্রহণ করতাম, এরপর ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা পরবর্তী দশটি আয়াত শিক্ষা করতাম না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা এই দশ আয়াতের ইলম ও আমল শিখতাম’ -[শরহে মুশকিলুল আছার : ১৪৫০]।

যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেয়া

কুরআন মাজীদ সম্মানিত এবং যারা কুরআনের সাথে থাকবে তাঁরাও সম্মানের অধিকারী। এজন্য কুরআনের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। কুরআন তিলাওয়াতের সময় তাঁর হক আদায় করতে হবে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

﴿ٱلَّذِينَ ءَاتَيۡنَٰهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ يَتۡلُونَهُۥ حَقَّ تِلَاوَتِهِۦٓ أُوْلَٰٓئِكَ يُؤۡمِنُونَ بِهِۦۗ وَمَن يَكۡفُرۡ بِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ١٢١﴾ [البقرة: ١٢١]

যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তাঁরা তা পাঠ করে যথার্থভাবে। তাঁরাই তাঁর প্রতি ঈমান আনে। আর যে তা অস্বীকার করে, সে-ই ক্ষতিগ্রস্থ’ -[সূরা আল-বাকারাহ : ১২১]। কুরআনকে মহববত করা  আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে মহববত করার শামিল। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

«من أحبَّ القرآنَ أحبَّ اللهَ ورسولهَ»

যে কুরআনকে মহববত করল সে  যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে মহববত করল’-[জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ৩২৯]।

কুরআন প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা

কুরআনের প্রচার, প্রসার ও তা প্রতিষ্ঠার কাজ করা কুরআনের অন্যতম হক। নিজ ব্যবস্থাপনায় কুরআন শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন, কুরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতা, হিফয প্রতিযোগিতা, কুরআন বুঝার আসর, তাফসীর প্রতিযোগিতা, মাকতাব চালু করা, বিভিন্ন এলাকায় কুরআনের মুয়াল্লিম প্রেরণ বা মুয়াল্লিম স্পন্সর করা, কুরআন বিতরণ করা, কুরআনের মুয়াল্লিম তৈরি করা, কুরআনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত সংস্থাকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা, এ কাজের অন্তর্ভুক্ত। সর্বোপরি কুরআনের বিধান সমাজে প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,

﴿وَأَنۡ أَتۡلُوَاْ ٱلۡقُرۡءَانَۖ فَمَنِ ٱهۡتَدَىٰ فَإِنَّمَا يَهۡتَدِي لِنَفۡسِهِۦۖ وَمَن ضَلَّ فَقُلۡ إِنَّمَآ أَنَا۠ مِنَ ٱلۡمُنذِرِينَ ٩٢﴾ [النمل: ٩٢]

আর আমি যেন আল-কুরআন অধ্যয়ন করি, অতঃপর যে হিদায়াত লাভ করল সে নিজের জন্য হিদায়াত লাভ করল; আর যে পথভ্রষ্ঠ হল তাকে বল, আমিতো সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত’ -[সূরা আন-নামল : ৯২]।

﴿۞يَٰٓأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغۡ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ مِن رَّبِّكَۖ ﴾ [المائ‍دة: ٦٧]

হে রাসূল, তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও [সূরা আল-মায়িদাহ : ৬৭]। কুরআন তিলাওয়াত, হিফয, প্রচার, প্রসার এবং প্রতিষ্ঠার কাজে আনন্দ প্রকাশ করার সুযোগ রয়েছে। কুরআন এমন একটি কিতাব যা নিয়ে ঈমানদার বান্দাহগণ আনন্দ প্রকাশ করতে পারে। কেননা আল-কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡكُم مَّوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَآءٞ لِّمَا فِي ٱلصُّدُورِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ ٥٧ قُلۡ بِفَضۡلِ ٱللَّهِ وَبِرَحۡمَتِهِۦ فَبِذَٰلِكَ فَلۡيَفۡرَحُواْ هُوَ خَيۡرٞ مِّمَّا يَجۡمَعُونَ ٥٨﴾ [يونس: ٥٧،  ٥٨]

হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত। বল, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম’ -[সূরা ইউনুস : ৫৭-৫৮]। আবূ সাইদ খুদরী রাদি আল্লাহু আনহু বলেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ হলো আল-কুরআন এবং এর অধিকারী হওয়াই রহমত’ -[শুয়াবুল ঈমান]।

প্রিয় পাঠক!

আমরা কি কুরআনের হকগুলো আদায় করতে পারছি? আদায় করার জন্য কোন প্রচেষ্টা আছে কি? আসুন কুরআনের হকগুলো আদায় করি, কিয়ামাতের সেই ভয়াবহ দিনে কুরআনের সুপারিশ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরআনের হকগুলো যথাযথভাবে পালন করার তাওফীক দিন। আমীন!


সুত্রঃ ইসলামহাউজ

Read More