ফাজায়েলে আমলের মূল লেখক মাওলানা জাকারিয়া (রঃ) এবং অনুবাদক মাওলানা ছাখাওয়াতউল্লাহ। কিতাবখানি তাবলীগী জামা’আত বাংলাদেশের আহলে শুরার বুজুর্গগণ কর্তৃক অনুমোদিত এবং তাবলীগী ফাউন্ডেশন ও তাবলীগী কুতুবখানা, ৫০ বাংলাবাজার, ঢাকা- ১১০০ কর্তৃক প্রকাশিত (ফেব্রুয়ারী, ২০০৫ সংস্করণ)। এ পুসকে ইসলামের কিরূপ চিত্র পেশ করা হয় এবং ধর্মের নামে পাঠককে কিরূপ কাজে উৎসাহ দেয়া হয় সেটির কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যাক। এখানে শিরক, বিদ’আত, সুদ ঘুষ বা এধরণের কোনো হাদিস স্থান পায়নি, পেয়েছে বিভিন্ন কেচ্ছাকাহিনী।
পবিত্র কোর’আনে বলা হয়েছে, “ফাযাক্কের বিল
কোর’আন” অর্থাৎ কোর’আনের সাহায্যে মানুষকে স্মরণ করাও। অর্থাৎ সাবধান করো। মহান
আল্লাহতায়ালার ভাষায় পবিত্র কোর’আন হলো “হুদাল্লিল মুত্তাকীন”, “সিরাতুল
মুস্তাকিম” এবং “হাবলিল্লাহিল মাতিন”। বলা হয়েছে “ওয়া মাই ইয়াতাছিম বিল্লাহ,
ফাক্বাদ হুদিয়া ইলা সিরাতিম মুস্তাকিম” অর্থাৎ আল্লাহপাক বলেন,
وَمَن يَعْتَصِم بِاللَّهِ فَقَدْ
هُدِيَ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে (কোর’আন) দৃঢ়ভাবে
অবলম্বন করলো সেই সিরাতুল মুস্তাকিম তথা সোজা পথে পরিচালিত হলো” (আল ইমরান, ১০১)।
এরপরও কি এ বিষয়টি বুঝতে বাকি থাকে, কোর’আন
হলো মুসলমানের জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে। মুসলমানের ইবাদত, পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ ও
সংস্কৃতি সবকিছু আবর্তিত হয় কোর’আনকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ‘ফাজায়েলে আমল’ বইটিতে
আল্লাহ কি বললেন সেটির তেমন উল্লেখ নেই বরং কোন সুফি বা কোন হুজুর কি বললেন সেটিরই
ছড়াছড়ি। মানুষকে হুশীয়ার করা হচ্ছে সুফীদের বা হুজুরদের বক্তব্য শুনিয়ে। মানুষের
কাছে কোর’আনের নির্দেশ পৌছানোর গরজ এখানে সামান্যই। ফাজায়েলে আমলের ৪ পৃষ্ঠায়
(কোনো সংস্করণে ৬ পৃষ্ঠায়) বলা হয়েছে, “কারো যদি দ্বীনের একটিমাত্র কথাও জানা থাকে
উহা অন্যের নিকট পৌছাতে হবে।” কিন্তু কথা হলো, মহান আল্লাহর কথা যদি জানা ও বোঝারই
চেষ্টা না করা হয় তবে সেটি অন্যের কাছে পৌছাবে কি করে? অন্যদের কাছে পৌছানো দূরে
থাক, মসজিদে মসজিদে নামাজ শেষে তাবলীগী জামা’আতের যে বৈঠক বসে সেখানেও কি কোর’আন
খুলে তার অর্থ বোঝার চেষ্টা করা হয়? সেখানে তো হুজুরদের বইই প্রাধান্য পায়,
আল্লাহর কিতাব নয়।
আল্লাহতায়ালার কাছে এটি প্রচন্ড অপছন্দের
যে, মানুষ তার নাযিলকৃত কিতাবকে শুধু সওয়াবের উদ্দেশ্যে পড়বে আর জীবনযাপন,
ঘরসংসার, পোষাকপরিচ্ছদ, শিক্ষা সংস্কৃতি, বিচার আচার, অর্থনীতি, প্রশাসন এমনকি
দ্বীনের তাবলীগের ক্ষেত্রে ন্সীহত ও নির্দেশনা নিবে অন্য কোনো কিতাব বা নেতা থেকে।
নসীহতের জন্য তাবলীগী জামা’আত এখানে বেছে নিয়েছে “ফাজায়েলে আমল”। তাবলীগীদের
প্রতিটি বাড়িতে ‘পবিত্র কোর’আন’ বা অন্য কোনো সহিহ হাদিসগ্রন্থ না থাকতে পারে তবে
‘ফাজায়েলে আমল’ বইটি থাকবেই। এটি বস্তুত মহান আল্লাহর কিতাবের প্রতি চরম অবমাননা।
এমন আচরণে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কখনোই খুশি হতে পারেন না। মহান আল্লাহতায়ালা তার
ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছেন এভাবে, “তোমাদের নিকট কি কোনো কিতাব আছে যা তোমরা পাঠ
করো? তাতে কি তোমরা তাই পাও যা তোমরা পছন্দ করো?” (সুরা কালাম, ৩৭-৩৮)।
তাবলীগী কর্মীগণ ফাজায়েলে আমল থেকে বস্তুত
সেটাই পায়, যা তাদের মন চায়। তারা পায়, তাবলীগী মিশন চালানোর নতুন প্রেরণা। কোর’আন
থেকে সেটি পায়না বলেই কোর’আন নিয়ে তারা বৈঠক করেনা, সে গ্রন্থ থেকে নসীহত লাভের
চেষ্টাও করেনা। কোর’আন বাদ দিয়ে অন্য কিতাব থেকে নসীহত নেয়ায় যে প্রচন্ড আগ্রহ
বাড়বে সেটি কোর’আন নাযিলের সময়ই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জানতেন। কারণ ‘আলিমূল
গায়েব’ মহান আল্লাহর অজানা থাকার কথা নয়। অনুরূপ কিছু হলে সেটি যে আল্লাহতায়ালার
ক্ষোভের কারণ হবে সেটিও তিনি পবিত্র কোর’আনে গোপন রাখেন নি। সুরা কালামের উপরোক্ত
দু’টি আয়াত হলো তার নমূনা।
উক্ত ‘ফাজায়েলে আমল’ বইতে বলা হয়েছে,
“সবচেয়ে উত্তম যিকির হলো পবিত্র কোর’আনের তেলাওয়াত, যেকোনো যিকির হইতে শ্রেষ্ঠ।
একথাও বলা হয়েছে, শ্রেষ্ঠ তেলাওয়াত হলো কোর’আন বুঝে তেলাওয়াত।” (ফাজায়েলে আমল, ১৫৫
পৃষ্ঠা)
একটি প্রসিদ্ধ হাদিসের উল্লেখও করা হয়েছে।
হাদিসটি হজরত ওসমান (রাঃ) থেকে উদ্ধৃত। হুজুরপাক (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে ঐ
ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ, যিনি কোর’আন শরীফ নিজে শিখেছেন এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছেন।” (ফাজায়েলে
আমল, ১৩৪ পৃষ্ঠা)
হজরত আয়েশা (রাঃ) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত
হয়েছে, “যাহারা কোর’আনে পারদর্শী তাহারা ঐসব ফেরেস্তাদের অন্তর্ভূক্ত যাহারা মহা
পূণ্যবান এবং আল্লাহর হুকুমনামা লেখায় ব্যস্ত।” (ফাজায়েলে আমল, ১৩৯ পৃষ্ঠা)
উল্লেখ করা হয়েছে তিরমিজী শরিফের একটি
হাদিস। হাদিসটি হলো, হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, “যার মধ্যে কোর’আনের কোনো
শিক্ষা নাই সে ঘর বিরান সমতুল্য।” (ফাজায়েলে আমল, ১৫৫ পৃষ্ঠা)
হজরত আবু জর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ)
বলেন, “হে আবু জর, তুমি যদি সকাল বেলায় গিয়া কালামুল্লাহ শরীফ হইতে একটি আয়াতও
শিক্ষা করো তবে একশত রাকাত নফল পড়া হইতেও উত্তম। আর ঐ সময় যদি ইলমের একটি অধ্যায়
শিক্ষা করো, চাই উহার উপর আমল হঊক বা না হঊক তবে উহা হাজার রাকাত নফল পড়া হইতেও
উত্তম।” (ফাজায়েলে আমল, ১৮১ পৃষ্ঠা)
কথা হলো তাবলীগী জামা’আত কি এর উপর বিশ্বাস
করে? তাবলীগী জামা’আতের জোর তো ফাজায়েলে আমল শিক্ষার প্রতি। তারা নামাজ শেষের
বৈঠকগুলোতে কি কখনো কোর’আন হাতে নিয়ে তা থেকে পাঠ করে? মুসলমানের শ্রেষ্ঠ কল্যাণ
করার যদি কারো আগ্রহ থাকে তবে তার উচিৎ মুসলমানদের মাঝে কোর’আন বোঝার সামর্থ
সৃষ্টি করা। সে জন্য আরবী ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিৎ। প্রশ্ন হলো, তাবলীগী জামা’আতের
লক্ষ লক্ষ লোক, কিন্তু তাদের ক’জনের সে সামর্থ? সে সামর্থ বাড়ানোরই বা উদ্যোগ
কোথায়? আর সে সামর্থ বাড়লে কি দ্বীনের প্রতি মানুষকে ডাকার সামর্থ বাড়তো না? তারা
যা বলে তা কি করে? তাই পবিত্র কোর’আনে আল্লাহপাক বলেন, “আল্লাহর কাছে বড়ই অপছন্দের
হলো, তোমরা যা বলো তা করো না” (সুরা সাফ, ৩)।