মানুষের জীবনধারণ, খাবার ও নানাবিধ প্রয়োজন পূরণে জন্য যেসব উপাদান প্রয়োজন, তার সবই বিশ্বপ্রকৃতিতে আল্লাহতায়ালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এগুলো উপার্জন সাপেক্ষ, মেহনতের সাহায্যে ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে হয়। যেমন জমি ও জন্তু-জানোয়ার। এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্বমানবতার জন্য নিয়ামত। তবে এসবের একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ নিজে। দুনিয়ার মানুষ নিজেদের ভোগ-বিলাস ও ফায়দা হাসিলের জন্য এগুলো ব্যবহার করার অধিকার পেয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য আল্লাহতায়ালা এগুলো দান করেছেন। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সবই তোমাদেরই কল্যাণ বা প্রয়োজন পূরণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (সুরা বাকারা, ২৯)
আল্লাহতায়ালা মানুষকে তার দয়ার অপার মহিমায় ভোগ-বিলাসের জন্য এসব নিয়ামত দান করেছেন। তাই বলে এসবের অপচয় ও ধ্বংস করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এ নিয়ামতগুলোর অপচয় ও ধ্বংস আজ ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে চলছে ব্যাপকহারে। মাটির নিচে আল্লাহতায়ালা দান করেছেন অফুরন্ত খনিজসম্পদ যা আমাদের জাতীয় সম্পদ। কিন্তু ব্যক্তি ও জাতীয় পর্যায়ে এ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও সংরক্ষণ কোনোটিই সঠিকভাবে হচ্ছে না। অযত্ন, অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে আল্লাহর এ নিয়ামতের আমানতদারিতার সুস্পষ্ট খেয়ানত হচ্ছে।
আল্লাহতায়ালার কাছে অফুরন্ত ও অসীম সম্পদের ভাণ্ডার রয়েছে। সর্বোপরি তিনি যখন যা ‘হও’ বলেন, তা হয়ে যায়। কমতি, সীমাবদ্ধতা, সংকীর্ণতা ও অভাব কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তদুপরি তিনি মানুষকে সম্পদ দানের পর আবার এর অপচয়ের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করলেন কেন? প্রকৃতপক্ষে মানুষকে একটি নিয়ম-শৃঙ্খলার আওতায় এনে জীবনকে সার্থক করে গড়ে তোলাই এর লক্ষ্য। কারণ লাগামহীন জীবনযাপন শয়তানের বৈশিষ্ট্য। শয়তানের কাছে ধরাবাঁধা নিয়ম-শৃঙ্খলা সহনীয় নয়। আর অপচয়, ভাঙন ও ধ্বংস শয়তানের কাজ। তাই অপচয় ও ধ্বংসাত্মক কাজ শয়তান ব্যতিরেকে কোনো মানুষের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
এমনিভাবে জাতীয় সম্পদের আমানতদার রাষ্ট্রের শাসকরা। তাদের অবহেলা ও ভুল সিদ্ধান্তের জন্য কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। কিন্তু আল্লাহর এ আমানত খেয়ানত করার অধিকার আল্লাহ তাদের দেননি। আল্লাহর কাছে তাদের অবশ্যই এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কারণ আল্লাহর এসব নিয়ামত সংরক্ষণের দায়িত্ব খোদ সরকারের।
আল্লাহতায়ালা তার অফুরন্ত ভাণ্ডার মানুষের জন্য খুলে দিতে চান। কিন্তু মানুষ যদি ক্রমাগত তাদের অযোগ্যতা, অসতর্কতা ও অদক্ষতার প্রদর্শন করতে থাকে এবং সম্পদকে বিভিন্নভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে থাকে তবে এটাকে আল্লাহতায়ালার প্রতি এক ধরনের অকৃতজ্ঞতা বলা যায়। এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাদের পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তাতেই তোমাদের জন্য জীবিকা-নির্বাহের যাবতীয় উপাদান সৃষ্টি করেছি কিন্তু তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞ।’ (সুরা আরাফ, ১০)
প্রকৃতির মধ্যে মানুষ এবং জন্তু-জানোয়ারের জন্য উদ্ভিদের চেয়ে পরম বন্ধু আর কিছু নেই। কেননা উদ্ভিদ শুধু মানুষের খাবার জোগায় না বরং বায়ু থেকে বিষাক্ত গ্যাস কার্বন-ডাই অক্সাইড শুষে নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন তৈরি করে। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর তিনি জমিনকে বিস্তার করে দিয়েছেন। আর তা থেকে পানি ও তরুলতাদি নির্গত করেছেন এবং পাহাড়কে তিনিই সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর তা (গাছ-গাছড়া) হলো তোমাদের এবং তোমাদের জন্তু-জানোয়ারদের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ।’ (সুরা আন নাযিয়াত, ৩০-৩৩)
কাজেই উদ্ভিদ বিশ্ববাসীর জন্য সাধারণ কোনো কিছু নয় বরং মহামূল্যবান সম্পদ। কোরআনে কারিমে অসংখ্যবার আল্লাহতায়ালা উদ্ভিদরূপ নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ অপরিণামদর্শী মানুষ বিনাপ্রয়োজনে বনের পর বন উজাড় করে চলছে। সেই সঙ্গে পাহাড় কেটে ও নদী-নালা ভরাট করছে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
একদা এক অভিযানকালে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) সৈন্যদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। (তখন) তিনি দেখতে পেলেন, কোনো কোনো সাহাবি হাতের অস্ত্রের আঘাতে পরিপার্শ্বস্থ গাছের ডালপালা কাটছেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের নিষেধ করলেন, আর বললেন, ‘খবরদার! অযথা তোমরা গাছপালার ওপরে আঘাত কোরো না। কেননা তাদের প্রাণ আছে তোমাদের আঘাতে তারা কষ্ট পায় ও কাঁদে।’
অপচয় একটি গর্হিত কাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য তিনটি বস্তু অপছন্দ করেন- ১. অনর্থক এবং বাজে কথা বলা, ২. নিষ্প্রয়োজনে মাল নষ্ট করা এবং ৩. অত্যধিক প্রশ্ন করা।’ (বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, আবূ দাউদ, আহমাদ, দারেমী)
ক. পানির অপচয়- বিনা প্রয়োজনে পানি ব্যয় করা অন্যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তুমি যদি সাগরপাড়ে বসেও পানি অতিরিক্ত ব্যবহার করো, তাও অপচয় হবে।
খ. খাওয়া দাওয়া- প্লেটে খাবার নিয়ে ফ্যাশন বা সৌজন্যবোধ মনে করে ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার না খাওয়া। আল্লাহ কুরআনে এরশাদ করেন, ‘এবং তোমরা আহার করো ও পান করো। কিন্তু অপচয় করো না। তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা আ’রাফ, ৩১)
গ. গ্যাসের অপচয়- গ্যাসের মিটার পদ্ধতি না থাকায় দেশের সবচেয়ে বেশি অপচয় হচ্ছে গ্যাস। মাসভিত্তিক বিলের কারণে এ অপচয়ের মাত্রা মহামারীর আকার ধারন করেছে। মনে রাখতে হবে, গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদ, বান্দার জন্য অল্লাহর অপার অনুগ্রহ।
ব্যক্তি পর্যায়ে দেখা যায়, বাসাবাড়িতে অনর্থক গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখা হয়। অমূল্য এ সম্পদ দিয়ে কাপড় শুকানো হয়। এমনকি একটি ম্যাচের শলাকা খরচ না করার জন্য গ্যাসের চুলা দীর্ঘক্ষণ নেভানো হয় না। এগুলো সুস্পষ্ট অপচয়। অপচয় বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘(ধন-সম্পদের) অপচয় করো না, যারা এভাবে ধন-সম্পদের অপচয় করে তারা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ।’(সুরা বনি ইসরাইল, ২৬-২৭)
ঘ. বিদ্যুতের অপচয় : লোডশেডিংয়ের মাঝেও আমরা বিদ্যুতের মারাত্মক অপচয় করি। বিশেষ করে অফিস-আদালত, কোয়াটার, রাস্তা-ঘাট, টয়লেটসহ অপ্রয়োজনীয় স্থানে সবসময় বিদ্যুতের অপচয় হয়। বিশেষ করে কোনো দিবস বা অনুষ্ঠান হলে আলোকসজ্জা, লাইটিংয়ের নামে বিদ্যুতের অপচয় আমাদের জাতীয় জীবনে বিদ্যৎ সংকট মহামারীর আকার ধারণ করেছে। যা রোধ করা সবার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
ঙ. সাজসজ্জা ও সৌন্দয্যবর্ধন- শারিরীক সৌন্দর্য বর্ধনে পোশাকের নামে আমরা যে সব পোশাক ক্রয় করে থাকি, তার ক্ষতির দিকগুলোই বেশি। একদিকে যেমন আর্থিক অপচয়, অন্যদিকে আল্লাহর বিধানের লংঘন। আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত বিষয়গুলো না ভেবে বেশি দামে পোশাক ও প্রসাধনী ক্রয়ে প্রতিযোগিতাও সীমাহীন অপচয় হয়। যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
এখানে শুধুমাত্র সামান্য কয়েকটি নিয়ামতের কথা উল্লেখ করা হলো। এছাড়াও মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে আল্লাহর দেওয়া অসংখ্য নিয়ামত ভোগ করছেন। এগুলোরও সুষম ব্যবহার কাম্য। সুতরাং আমাদের উচিত মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা। অপচয়ের বিষয়ে আমাদের করণীয় কি হবে তা আল্লাহ তাআলা কুরআনে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপচয় করে না, কাপর্ণ্যও করে না বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়।’ (সূরা ফুরকান, ৬৭)।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সমস্ত ধরনের অপচয় করা থেকে হেফাজত করুন। (আমীন)