Time & Date::
আসসালামু আলাইকুম। ভিজিট করার জন্য আপনাকে স্বাগতম।। এই ওয়েব ব্লগটি সকল মুসলিম ভাইবোনদের জন্য উৎসর্গ করা হলো আলহামদুলিল্লাহ। অনুগ্রহ করে নিয়মিত চোখ রাখুন।। কারও কোনো জিজ্ঞাস্য থাকলে অনুগ্রহ করে নিচে 'যোগাযোগ' লিংকে ক্লিক করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

ইসলামে আত্মীয়তা রক্ষার গুরুত্ব এবং আত্মীয়তা ছিন্নতার ভয়াবহ পরিণাম

ক) আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার ফযীলত:
আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার ফযীলত বহুবিধ। তন্মধ্যে কতিপয় দিক এখানে উল্লেখ করা হ’ল।-

১. আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানের পরিচায়ক:
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ঈমানের পরিচায়ক। রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে’। (বুখারী, ৬১৩৮)

২. আল্লাহর আনুগত্যের প্রকাশ:
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা আল্লাহর আনুগত্য করার বহিঃপ্রকাশ। মহান আল্লাহ বলেন, 'আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন যারা তা অক্ষুণ্ণ রাখে, ভয় করে তাদের প্রতিপালককে এবং ভয় করে কঠোর হিসাবকে’ (রা‘দ ১৩/২১)।

৩. আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম:
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, 'রেহেম’ (রক্তের বাঁধন) ‘রহমানের’ অংশ বিশেষ। সে বলবে, ‘হে প্রভু! আমি মাযলূম, আমি ছিন্নকৃত। হে প্রভু! আমার সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়। হে প্রভু! হে প্রভু! তখন তার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা জবাব দিবেন, তুমি কি সন্তুষ্ট নও যে, যে ব্যক্তি তোমাকে ছিন্ন করবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব এবং যে তোমাকে যুক্ত করবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক জুড়ে রাখব’? (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৫, সনদ ছহীহ।)

৪. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অছিয়ত প্রতিপালন করা:
নবী করীম (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে স্বীয় উম্মতকে বিভিন্ন বিষয়ে অছিয়ত করেছেন। তন্মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা অন্যতম। সুতরাং আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা হ’লে তাঁর উপদেশ প্রতিপালন করা হবে। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, আবু যর গিফারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমার বন্ধু নবী করীম (ছাঃ) আমাকে কতিপয় উত্তম গুণের ব্যাপারে উপদেশ দেন। তিনি আমাকে উপদেশ দেন যে, আমি যেন আমার চেয়ে উঁচু স্তরের লোকের দিকে লক্ষ্য না করি; বরং আমার চেয়ে নিম্নস্তরের লোকের দিকে তাকাই। তিনি আরো উপদেশ দেন, দরিদ্রদের ভালবাসতে ও তাদের নিকটবর্তী হ’তে। তিনি উপদেশ দেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে, যদিও তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে...’। (ছহীহ আত-তারগীব হা/২৫২৫, সনদ ছহীহ।)

৫. আল্লাহর নিকট অন্যতম প্রিয় আমল:
মানুষের কৃত অনেক আমল আল্লাহর নিকটে প্রিয় ও পসন্দনীয়। তন্মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা অন্যতম। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, ‘খাছ‘আম গোত্রের জনৈক লোক হ’তে বর্ণিত সে বলল, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর দরবারে আসলাম। তিনি তখন ছাহাবীদের একটি ক্ষুদ্র দলের সাথে ছিলেন। আমি বললাম, আপনিতো সেই ব্যক্তি যিনি ধারণা করেন যে, আপনি আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাবী বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কোন আমল আল্লাহর নিকটে পসনদনীয়? তিনি বললেন, আল্লাহর উপরে ঈমান আনা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কোন আমল আল্লাহর নিকটে অপসন্দনীয়? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, গর্হিত কাজের নির্দেশ দেওয়া এবং সৎকাজে নিষেধ করা’। (ছহীহ আত-তারগীব হা/২৫২২, সনদ ছহীহ।)

৬. বয়স ও রিযিক বৃদ্ধির উপায়:
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে মানুষের বয়স ও জীবিকা বৃদ্ধি পায়। এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে চায় যে, তার জীবিকা প্রশস্ত হোক এবং আয়ু বৃদ্ধি পাক, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সাথে ঘনিষ্ঠ আচরণ করে’। (বুখারী হা/২০৬৭, ৫৯৮৫; মুসলিম হা/২৫৫৭)

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যে তার জীবিকার প্রশস্ততা এবং আয়ু বৃদ্ধি পসন্দ করে, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম আচরণ করে’। (বুখারী হা/৫৯৮৬; মুসলিম হা/২৫৫৭)

এখানে বয়স বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে হায়াতে বরকত লাভ করা। সেই সাথে সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ দেহ, শক্তিমত্তা এবং অধিক কাজ করার ক্ষমতা লাভ করা। (কাতী‘আতুর রাহিমু, ১/৯ পৃঃ)

কেউ কেউ বলেন, বয়স ও রিযিক বৃদ্ধির তাৎপর্য হচ্ছে যে, আল্লাহ প্রকৃতই বান্দার বয়স ও জীবিকা বাড়িয়ে দেন। এখানে এ প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ নেই যে, বয়স ও রিযিক নির্ধারিত; সুতরাং তা কিভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে? কেননা হায়াত ও রিযক দু’ধরনের। যথা- ১. সাধারণ, যা কেবল আল্লাহ জানেন। এটা অপরিবর্তিত। ২. লিপিবদ্ধ, যা তিনি ফেরেশতাদের মাধ্যমে লিখিয়েছেন ও তাদের অবহিত করেছেন; বিভিন্ন কারণ ও ঘটনার প্রেক্ষিতে এটা হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমু‘ ফাতাওয়া, ৮/৫১৭, ৫৪০)

৭. আত্মীয়দের মাঝে পারস্পরিক মুহাববত বৃদ্ধির মাধ্যম:
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ভালবাসার বন্ধন সুদৃঢ় হয়। হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালককে ভয় করে এবং তার আত্মীয়-স্বজনকে জুড়ে রাখে, তার মৃত্যু পিছিয়ে দেওয়া হয়, তার সম্পদ বৃদ্ধি করা হয় এবং তার পরিবার-পরিজন তাকে ভালবাসে’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৮, সনদ হাসান)

অন্য শব্দে এসেছে এভাবে, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালককে ভয় করে, আত্মীয়তার বন্ধন জুড়ে রাখে, তার আয়ু বর্ধিত করা হয়, তার ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করা হয় এবং তার পরিবার-পরিজন তাকে ভালবাসে। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯, সনদ হাসান)

তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা তোমাদের বংশপরিচয় শিখে নাও, যা দ্বারা তোমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে। কেননা আত্মীয়তার সম্পর্ক পরিবার-পরিজনের মধ্যে হৃদ্যতা বৃদ্ধি করে, সম্পদ বাড়ায় এবং বয়স বৃদ্ধি করে’। (তিরমিযী হা/১৯৭৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭৬; মিশকাত হা/৪৯৩৪)

৮. পৃথিবীর অধিবাসীদের উন্নয়ন:
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা পৃথিবীবাসীদের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে এবং তাদের বয়স বৃদ্ধি করে। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) তাকে বলেছেন, ‘যাকে নম্রতা দান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের বহু কল্যাণ দেওয়া হয়েছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা, উত্তম চরিত্র ও সৎ প্রতিবেশী দুনিয়ার অধিবাসীদের উন্নয়ন ঘটায় এবং বয়স বৃদ্ধি করে’। (মুসনাদ আহমাদ; সিলিসিলা ছহীহাহ হা/৫১৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৫২৪)

৯. দ্রুত ছওয়াব লাভের উপায়:
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখলে অবিলম্বে ছওয়াব বা প্রতিদান লাভ করা যায়। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর আনুগত্যে সম্পন্ন এমন কোন কাজ নেই, যার মাধ্যমে দ্রুত ছওয়াব লাভ করা যায় আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ব্যতীত। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ও বিদ্রোহ করা ব্যতীত কোন কাজে দ্রুত শাস্তি আপতিত হয় না’। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা ১০/৬২; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৩৯১; ছহীহাহ হা/৯৭৮)

১০. আত্মীয়তার সম্পর্ক ক্বিয়ামতের দিন সাক্ষী দিবে:
যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে ক্বিয়ামতের দিন অপরাপর আত্মীয়-স্বজন তার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘রক্তের বন্ধন ক্বিয়ামতের দিন তার সংশ্লিষ্টজনের সম্মুখে এসে দাঁড়াবে এবং যদি সে তাকে দুনিয়ায় যুক্ত রেখে থাকে, তবে সে তার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে, যদি সে তাকে দুনিয়ায় ছিন্ন করে থাকে, তবে সে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭৭)

১১. জান্নাতে প্রবেশের উত্তম মাধ্যম:
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে জান্নাতে প্রবেশ করা সহজ হয়। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, বারা ইবনু আযীব (রাঃ) বলেন, একদা জনৈক বেদুঈন নবী করীম (ছাঃ)-এর খেদমতে এসে আরয করল, হে আল্লাহর নবী (ছাঃ)! আমাকে এমন একটি আমল শিক্ষা দিন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘তোমার কথা যদি এই পর্যন্তই হয়ে থাকে, তবে একটা প্রশ্নের মতো প্রশ্নই তুমি করেছ। গোলাম আযাদ কর এবং গর্দান মুক্ত কর’। সে ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! দু’টা একই বস্ত্ত নয় কি? নবী করীম (ছাঃ) বললেন, না, গোলাম আযাদ করা তো কোন গোলামকে আযাদ করাই এবং গর্দান মুক্ত করা মানে আত্মীয়-স্বজনের মুক্তির জন্য সাহায্য করা এবং প্রিয় বস্ত্ত (অর্থ-সম্পদ) দান করা। যদি তা না পার, তবে ক্ষুধার্তকে খাদ্য খাওয়াবে, পিপাসার্তকে পানি পান করাবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে। যদি তাতেও সমর্থ না হও, তবে কল্যাণকর কথা ব্যতীত তোমার মুখ বন্ধ রাখবে’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৮; মিশকাত হা/৩৩৮৪, সনদ ছহীহ)

অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘হে লোক সকল! পরস্পর সালাম বিনিময় কর, অন্যকে খাদ্য খাওয়াও, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ, রাতে ছালাত আদায় কর মানুষ যখন ঘুমন্ত থাকে, নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ কর’। ইবনু মাজাহ হা/৩৩৭৪; মিশকাত হা/১৯০৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫৬৯)


খ) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার অর্থ:
আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট ও ছিন্ন হওয়ার অর্থ ও তাৎপর্য হচ্ছে জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর সাথে দুর্ব্যবহার করা, তাদের প্রতি অনুগ্রহ, অনুকম্পা পরিহার করা, পূর্ববর্তী আত্মীয়দের বংশধরদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা, শারঈ ওযর ব্যতীত তাদের প্রতি ইহসান না করা, কারো প্রতি আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট করার দোষ চাপানো ইত্যাদি। (মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম আল-হামদ, কাতী‘আতুর রাহিম, পৃঃ ২)

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার হুকুম:
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা কবীরা গোনাহ। (ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়িমাহ ২৫/২৪৭)। কেননা আল্লাহ আত্মীয়দের সাথে সদাচরণ করতে এবং তাদের হক যথাযথভাবে আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন (নিসা ৪/৩৬; বানী ইসরাঈল ১৭/২৬-২৭)। অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন (বুখারী হা/১৩৯৬) এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না বলে উল্লেখ করেছেন (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৪, সনদ ছহীহ)। বিশেষ করে পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা হারাম (বুখারী হা/২৪০৮; মুসলিম হা/২৫৯৩; বুখারী হা/২৬৫৪; মুসলিম হা/৮৭; তিরমিযী হা/১৯০১)। আর অন্যান্য আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা গোনাহের কারণ, যা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে।

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার অপকারিতা ও পাপ:
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা অতি বড় গোনাহের কাজ। এর ফলে পারস্পরিক বন্ধন নষ্ট হয়, বংশীয় সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হয়, শত্রুতা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়, বিচ্ছিন্নতা ও একে অপরকে পরিত্যাগ করা অবধারিত হয়। এটা পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, হৃদ্যতা ও ভালবাসা দূর করে, অভিশাপ ও শাস্তি ত্বরান্বিত করে, জান্নাতে প্রবেশের পথকে বাধাগ্রস্ত করে, হীনতা ও লাঞ্ছনা আবশ্যক করে। এছাড়া এর কারণে মানবমনে চিন্তা ও পেরেশানী বৃদ্ধি পায়। কেননা মানুষ যার নিকট থেকে ভাল ব্যবহার, কল্যাণ ও সুসম্পর্ক কামনা করে, তার পক্ষ থেকে কোন বিপদ আসলে সেটা অধিক পীড়াদায়ক ও অসহনীয় হয়। এতদ্ব্যতীত পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বর্ণনামতে জ্ঞাতি সম্পর্ক ছিন্ন করার কিছু পাপ ও অপকারিতা নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-

১. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী অভিশপ্ত:
কুরআন মাজীদে আল্লাহ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীকে অভিশপ্ত বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হ’লে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আল্লাহ এদেরকে লা‘নত করেন এবং করেন বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২২-২৩)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুর রহমান ইবনু নাছের আস-সা‘দী বলেন, এতে দু’টি বিষয় রয়েছে। ১. আল্লাহর আনুগত্য আবশ্যকীয় করে নেয়া এবং তাঁর আদেশকে যথার্থভাবে পালন করা। এটা কল্যাণ, হেদায়াত ও কামিয়াবী। ২. আল্লাহর আনুগত্য থেকে বিমুখ হওয়া, তাঁর নির্দেশ প্রতিপালন না করা। যার দ্বারা দুনিয়াতে কেবল বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। আর এ বিপর্যয় সৃষ্টি হয় পাপাচার ও অবাধ্যতামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে এবং জ্ঞাতি বন্ধন ছিন্ন করার কারণে। তারাই ঐসকল লোক যারা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার মাধ্যমে। আল্লাহ স্বীয় রহমত থেকে তাদেরকে দূর করে দিয়ে এবং তাঁর ক্রোধের নিকটবর্তী করে তাদের অভিসম্পাত করেন’। (আব্দুর রহমান ইবনু নাছের আস-সা‘দী, তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, ১/৭/৮৮, সূরা মুহাম্মাদ ২২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ)।

অন্যত্র তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের জন্য আছে লা‘নত এবং তাদের জন্য আছে মন্দ আবাস’ (রা‘দ ১৩/২৫)।

২. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ক্ষতিগ্রস্ত ফাসেকদের দলভুক্ত:
জ্ঞাতি সম্পর্ক বিনষ্টকারী পাপাচারী ও ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘বস্ত্তত তিনি ফাসেকদের ব্যতীত কাউকে বিভ্রান্ত করেন না। যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত’ (বাক্বারাহ ২/২৬-২৭)।

৩. পার্থিব শাস্তি ত্বরান্বিত হওয়া ও পরকালীন শাস্তি বাকী থাকা:
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার কারণে পরকালে কঠোর শাস্তি তো রয়েছেই। তাছাড়া দুনিয়াতেও তাদের দ্রুত শাস্তি হবে। আবু বকর (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বিদ্রোহী ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর ন্যায় অন্য কাউকে পৃথিবীতে দ্রুত শাস্তি দেয়ার পরও পরকালীন শাস্তিও তার জন্য জমা করে রাখেননি’। (আবু দাঊদ হা/৪৯০২; তিরমিযী হা/২৫১১; ইবনু মাজাহ হা/৪২১১; মিশকাত হা/৪৯৩২)।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন এবং বিদ্রোহের মত দুনিয়াতেই ত্বরিৎ শাস্তির উপযুক্ত আর কোন পাপ নেই। পরকালে তার জন্য যে শাস্তি সঞ্চিত রাখা হবে, তা তো আছেই’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৭, সনদ ছহীহ)।

৪. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর সাথে আল্লাহ সম্পর্ক ছিন্ন করেন:
যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে মহান আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা যখন সমস্ত সৃষ্টি জগতকে সৃষ্টি করলেন, তখন ‘রেহেম (আত্মীয়তা)’ উঠে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কোমর ধরল। আল্লাহ তা‘আলা জিজ্ঞেস করলেন, কি চাও? সে বলল, এটা হ’ল আত্মীয়তা ছিন্নকারী হ’তে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার স্থান! তিনি বললেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, যে তোমার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে, আমিও তাকে ছিনণ করব? রেহেম বলল, জ্বী হ্যাঁ, প্রভু! তিনি বললেন, এটা তো তোমারই জন্য। অতঃপর আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, ইচ্ছা হ’লে পড়তে পার, ‘তবে কি (হে মুনাফিক সমাজ!) তোমরা আধিপত্য লাভ করলে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন সমূহকে ছিন্ন করবে’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২২)। (আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৫০, সনদ ছহীহ)।

রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, আমিই রহমান (দয়ালু), আমি আমার নাম (রহমান) থেকেই ‘রাহেম’ (আত্মীয়তার বন্ধন)-এর নাম নির্গত করেছি। সুতরাং যে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব এবং যে তাকে ছিন্ন করবে, আমি তাকে আমা হ’তে ছিন্ন করব’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৩, সনদ ছহীহ)।

৫. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না:
জ্ঞাতি সম্পর্ক বিনষ্টকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (বুখারী হা/৫৯৮৪; মুসলিম, হা/২৫৫৬; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৪)। তিনি আরো বলেন, ‘জান্নাতে প্রবেশ করবে না মদ পানকারী, জাদুতে বিশ্বাসী ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী’ (সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৭৮)।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা অতি বড় গোনাহের কাজ। একাজের মাধ্যমে দুনিয়াতে বিভিন্ন লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও শাস্তি রয়েছে, পরকালে তো বটেই। তাই আমাদেরকে এ থেকে সাবধান হ’তে হবে এবং আত্মীয়তা সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। এমনকি আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীদের থেকে দূরে থাকা যরূরী। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) বালক ও নির্বোধদের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব হ’তে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। রাবী সাঈদ ইবনু সাম‘আন (রাঃ) বলেন, ইবনু হাসানা জুহানী তাঁকে বলেছেন, তিনি আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন যে, এর নিদর্শন কি? তিনি বললেন, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা হবে, বিভ্রান্তকারীর আনুগত্য করা হবে এবং সৎপথ প্রদর্শনকারীর অবাধ্যতা করা হবে (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৬, সনদ ছহীহ)।

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা অতীব যরূরী। কেননা এটা হায়াত ও রিযক বৃদ্ধির মাধ্যম এবং জান্নাত লাভের উপায়। পক্ষান্তরে আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট করা জান্নাত থেকে মাহরূম হওয়ার কারণ। এজন্য রাসূল (ছাঃ) তাঁর মৃত্যুশয্যায় থাকাকালে উম্মতকে সাবধান করে বলেন, أَرْحَامَكُمْ أَرْحَامَكُمْ ‘তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন’ (সম্পর্কে সাবধান হও)। (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৩৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৭৩৬, ১৫৩৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৮৯৪, সনদ ছহীহ)।

অতএব প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ-নারীকে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। (আমীন!)

Facebook Comment