Time & Date::
আসসালামু আলাইকুম। ভিজিট করার জন্য আপনাকে স্বাগতম।। এই ওয়েব ব্লগটি সকল মুসলিম ভাইবোনদের জন্য উৎসর্গ করা হলো আলহামদুলিল্লাহ। অনুগ্রহ করে নিয়মিত চোখ রাখুন।। কারও কোনো জিজ্ঞাস্য থাকলে অনুগ্রহ করে নিচে 'যোগাযোগ' লিংকে ক্লিক করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

হজ্জ



হজ্জ কি ও কখন: হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্য পবিত্র হজ ইসলামের মহান একটি রূকন বা স্তম্ভ। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদে পরিস্কার ভাষায় সামর্থবান মুসলিম নর-নারীর উপরে জীবনে একবার এ মহান ইবাদতটি হজ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন- মানুষের মধ্যে যে ব্যক্তি (ঈমানদার) কাবাঘর পৌঁছতে সক্ষম হয় তার উপর আল্লাহর প্রাপ্য হচ্ছে সে যেন হজ করে। (আল-ইমরান-৯৬)

মূলতঃ এই হজ্জের মাধ্যমেই মহান আললাহর সামনে বান্দাহর গোলামীর চিত্রপূর্ণতা পায়। একজন হাজীর যাবতীয় কর্মকান্ডে বিশেষতঃ তাঁর ইহরাম অবস্থায় চূড়ান্ত বিনয় ফুটে উঠে। বাড়ী-ঘর, আত্মীয়-স্বজন, ধন-সম্পদ, আভিজাত্য-কৌলিন্য সবকিছু পেছনে ফেলে মাত্র দুইপ্রস্থ সাদা কাফন সদৃশ ইহরামের পোষাক গায়ে জড়ায়ে খালি মাথায় খোল পায়ে দূর-দূরান্ত থেকে, বলতে বলতে যখন পেরেশান হয়ে কাবা মুখে ছুটতে থাকে তখন মনে হয় মাহবুবের ডাকে সাড়া দিয়ে গাপল প্রেমিক দুনিয়ার সব কিছু তুচ্ছ করে ঊর্ধ্বশ্বাসে চলছে এক মহামিলনের প্রচন্ড আকর্ষণে। কাবা ঘরে পৌঁছে যখন সে এর চতুষ্পার্শ্বে তাওয়াফ করতে থাকে তখন মনে হয় পাগল পারা প্রেমিক তাঁর মাহবুবকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। কখনো হজরে আসওয়াদে চুমু খায়, কখনো মুলতাযামে বুক-মাথা ঠেকিয়ে অসহায়-এতীমের মত অঝোর ধারায় ফুফিয়ে-ফুফিয়ে কাঁদতে থাকে, কখনো ভিখারীর ন্যায় মীযাবে রহমতের নীচে দাঁড়িয়ে থাকে, আবার মাক্বামে ইবরাহীমের পেছনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে, ছাফা মারওয়ার মাঝে ছুটোছুটি করে, মাবুদের সন্তুষ্টির জন্য সব ছেড়ে চলে যায় মিনায়, আবার সে ছুটে চলে আরাফায়, সেখান থেকে খোলা আকাশের নীচে পাথুরে জমির উপর রাতের অন্ধকারে মুযদালিফায় বসে মনের আবেগে ডাকতে থাকে মহান মাবুদকে। তাঁকে রাজী করার জন্য চিরদুশন শয়তানকে মিনায় পাথর মেরে অপদস্ত করে, সর্বোপরি সকল অহংকার-অহমিকা, ব্যক্তিত্ব জলাঞ্জলী দিয়ে মাথা মুন্ডিয়ে চরম বিনয় সহকারে হাজির হয় মাবুদের দরবারে। গোলামী প্রকাশের আর কি বাকী থাকে? এ জন্যই হজ সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত, সকল ইবাদতের অনুপম সমন্বয়। পৃথিবীর সকল দেশের সকল ভাষার সকল বর্ণের মুসলিম নর-নারী, আবালবৃদ্ধবর্ণিতা যখন আরাফাতে, মুযদালিফায়, মীনায়, কাবায় একই পোষাকে একই ভাষায় লাব্বাইকা ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলে তখন বিশ্ব জগত এক অনন্য দৃশ্য অবলোকন করে। এ দৃশ্য নয়ন জুড়িয়ে দেয়, শ্রদ্ধা ভালবাসা আর আবেগের জোয়ারে সকল হিংসা-বিদ্বেষ ভেদাভেদ ধুয়ে মুছে যায়। সকলের প্রতি সকলের ভালবাসা, মমতা, সহমর্মিতা, সহযোগিতার কি এক অদৃশ্য বন্ধন! সবার গন্তব্য এক, চাওয়া-পাওয়া এক আল্লাহর সন্তুষ্টি। মহান মাবুদের দরবারে এসে বিশ্ব মুসলিম একাকার হয়ে যায়। এ হজ বিশ্ব মুসলিমকে একাত্মা করে দেয় বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ও বিশ্ব শান্তির স্বাদ জাগিয়ে দেয়।

হজের ফজিলত ও তাৎপর্য : কাবার সামনে মহান মাবুদের দুয়ারে প্রতিটি হাজী যেন নিজ পরিবার, সমাজ, দেশ ও মুসিলম জাতির প্রতিনিধি হয়ে আরজি পেশ করে। তাই পবিত্র হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্য শুধু ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং এর বরকতে গোটা মুসলিম উম্মাহ স্নাত হয়। হজ্জের ফযীলত অসংখ্য ছওয়াব, রহমত, বরকত আর মর্যাদায় পরিপূর্ণ মহান ইবাদাত হজ। যার জীবনে একটিবার হজ পালনও নসীব হয় সে অতীব সৌভাগ্যবান। মুমিনে জীবনে হজ্জের চেয়ে মহান আর কোন ইবাদত আছে? হজ্জের মাধ্যমে মুমিনদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে যায়। ইহরাম গায়ে হাজীর লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (আমি আপনার দরবারে হাজির হে আল্লাহ আমি হাজির) ধ্বনি মূলতঃ আল্লাহর নির্দেশিত ইবরাহীম [আ.]-এর আহবানের সাড়া দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন- "এবং (হে ইবরাহীম) মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সকল প্রকার কৃশকায় উটের পিঠে চড়ে দূর-দূরান্ত থেকে (সূরা হজ, আয়াত-২৭) এরপরই আল্লাহ ঘোষণা দেন তাদের এ আগমন হবে যেন তারা তাদের কল্যাণের স্থানে পৌঁছে। (সুরা হজ, আয়াত-২৮)"

এ আয়াতে হজ্জের ব্যাপক উপকারিতার প্রতি ঈঙ্গিত করা হয়েছে। হজ্জের পরকালিন ও ধর্মীয় উপকারিতাতো আছেই পার্থিব উপকারও অনেক, কোন কোন বর্ণনায় আছে হজ ও উমরায় ব্যয় করলে দারিদ্র ও অভাবগ্রস্ততা দূর হয়ে যায়। হজ্জের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল জান্নাত। হযরত আবু হুরায়রা [রা.] হতে বর্ণিত রাসূল [সা.] ইরশাদ করেন- গুনাহমুক্ত গ্রহণযোগ্য হজ্জের একমাত্র বিনিময় আল্লাহর জান্নাত। (বুখারী ও মুসলিম)

হজ্জের ফযীলত এত বেশী যে উহা হাজীকে গুনাহমুক্ত পবিত্র নতুন জীবন এনে দেয়। হযরত আবু হুরায়রা [রা.] বর্ণনা করেন যে, রাসূল [সা.] ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি হজ করল এর মধ্যে কোন অশ্লীল ও মন্দ কাজ করল না সে এমন নিষ্পাপ হয়ে বাড়ী ফিরল যেমন তাঁর মা তাঁকে নিষ্পাপ অবস্থায় প্রসব করেছিল। (বুখারী ও মুসলিম)

হজ্জের ফযীলত এত বেশী ব্যাপক যে, শয়তান তা প্রত্যক্ষ করে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে যায়। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা [রা.] হতে বর্ণিত রাসূল [সা.] বলেন- আরাফাত দিনের চেয়ে বেশী সংখ্যক বান্দাহকে অন্য কোন দিনই আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন না। (মুসলিম)

হযরত তালহা [রা.] বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ [সা.] ইরশাদ করেন- আরাফাতের দিন (হজ্জের দিন) শয়তানকে সর্বাধিক হীন, পেরেশান, ইতর ও ক্রোধান্বিত দেখা যায়, এটা এ জন্য যে, এ দিন আল্লাহর অফুরন্ত রহমত বর্ষণ ও বান্দাহর বড় বড় গুনাহ মাফের বিষয়টি শয়তান প্রত্যক্ষ করে। বদর যুদ্ধের দিনেও এমনটি হয়েছিল। নিম্নবর্ণিত হাদিসটি হতে হজ্জের ফযীলতের আরো ব্যাপকতা অনুধাবন করা যায়।

হযরত আবু মুসা [রা.] বর্ণনা করেন- রাসুলুল্লাহ [সা.] বলেন- হাজী তাঁর পরিবারের ৪০০ লোকের বিষয়ে সুপারিশ করতে পারবেন। আর হাজী তাঁর গুনাহ রাশি থেকে এমনভাবে বের হয়ে নিষ্পাপ হয়ে যান যেমন তাঁর মা তাঁকে নিষ্পাপ অবস্থায় ভূমিষ্ট করেছিলেন। (বাযযার)

হাজী যখন ইহরাম পরে এ মহান ইবাদতে মশগুল হয় তখন তাঁর সম্মানার্থে চতুস্পার্শ্বের সৃষ্টি জগতও অংশগ্রহণ করে। হযরত সাহল ইবনে সাদ [রা.] হতে বর্ণিত- রাসূল [সা.] ইরশাদ করেন! যখন কোন মুসলিম ইহরাম পরে তালবিয়্যাহ পড়তে থাকে তখন ডান ও বামের পাথর, বৃক্ষ, মাটিকণা সবকিছু এমনকি যমীনের এ প্রান্ত থেকে নিম্নের সর্বশেষ অংশ পর্যন্ত তালবিয়্যাহ পড়তে থাকে। (তিরমিযী)

হযরত বুরাইদা [রা.] বলেন- রাসুলুল্লাহ [সা.] ইরশাদ করেন- হজ্জে অর্থ ব্যয় করা আল্লাহর পথে জিহাদে ব্যয় করার সমান। এতে ৭০০ গুণ সওয়াব রয়েছে (আহমাদ)।

অন্য হাদীছে এসেছে- তোমরা হজ ও উমরাহ পাশাপাশি আদায় কর কেননা এ দুটো দারিদ্র ও পাপকে দূর করে দেয় যেমন রেত স্বর্ণ, রৌপ্য ও লৌহ থেকে মরিচা দূর করে দেয়। (তিরমিযী)

হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর [রা.] হতে বর্ণিত- রাসুলুল্লাহ [সা.] বনেল- যখন হাজীর সাথে তুমি সাক্ষাত কর তখন তাঁকে সালাম দাও এবং মোছাফাহা করে তাঁর গৃহে প্রবেশ করার আগে তোমার গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করতে বল। কেননা হাজী নিজে গুনাহ মুক্ত হয়ে এসেছে। (আহমাদ)

এভাবে অসংখ্য হাদীসে হজ্জের ফযীলত বর্ণিত আছে। হজ সকল দিক থেকে এক অনন্য ইবাদত। বান্দাহকে সর্বোচ্চ মানের মুত্তাকী ও সর্বোচ্চ ছওয়াবের অধিকারী বানাতে হজ্জের সমকক্ষ অন্য কিছু নেই। তাই সামর্থ থাকা সত্ত্বেও হজ না করা বা বিলম্ব করা চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা। সাহাবায়ে কেরাম [রা.], তাবেয়ীগণ ও বুযুর্গানে দ্বীন অজস্র কর্মব্যস্ততা ও কঠিন অবস্থার মধ্যেও বহুবার হজ সমাপন করতেন। বর্ণিত আছে ইমাম আযম হযরত আবু হানিফা (রহঃ) সুদূর কুফা নগরী থেকে পঞ্চান্নবার হজ্জে গমন করেছেন। হজ কার উপর কখন হজ হজ এমন একটি ইবাদত যা কাবা ঘর, মীনা, আরাফাত ও মুযদালিফায় গিয়ে আদায় করতে হয়।

সে জন্য ইহা কারো উপর হজ হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন-
(১) মুসলমান হওয়া, কোন কাফিরের জন্য হজ আদায় করার অনুমতি নেই।
(২) প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন হওয়া, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও পাগলের উপর হজ হজ নয়। এমতাবস্থায়ও যদি হজ করে তাহলে তার হজ হবে, সওয়াব পাবে। তবে পরবর্তীতে বালেগ হওয়ার বা সুস্থ হওয়ার পর সামর্থ থাকলে হজ হজ আদায় করতে হবে।
(৩) আযাদ বা স্বাধীন হওয়া। দাস-দাসীর উপর হজ হজ নয়। তবে বর্তমানে মুসলিম সমাজে দাস-দাসী নেই।
(৪) হজ আদায় করার সামর্থ থাকা। কেননা আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি কাবার পৌঁছার সামর্থ রাখে হজ করা তার উপর আল্লাহর হক্ক। (আল-ইমরান-৯৬)। এ সামর্থ তিনদিক থেকে থাকা শর্ত, যথাঃ (ক) দৈহিক সামর্থ। অর্থাৎ, কাবাঘর পর্যন্ত সফর করার শারিরীক যোগ্যতা থাকা। শারিরীকভাবে অক্ষম, অন্ধ, খোঁড়া, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, জরাজীর্ণ বৃদ্ধ স্বয়ং চলাফেরায় অক্ষম এরূপ লোকের উপর হজ হজ নহে, তবে অধিকাংশ আলেমের মতে এরূপ ব্যক্তির আর্থিক সামর্থ থাকলে বদলি হজ করানো ওয়াজিব। (খ) আর্থিক সামর্থ। অর্থাৎ পরিবার-পরিজন, চাকর-বাকরদের ভরণপোষণ নিশ্চিত করে কোন ব্যক্তির নিকট হজ্জে যাওয়া-আসা ও পাথেয় খরচ থাকলে তার উপর হজ হজ। বাসস্থান, প্রয়োজনীয় গৃহসামগ্রী, পোষাক-পরিচ্ছদ, ব্যবহৃত বাহন, পরিবার-পরিজন, চাকর-বাকরের যাবতীয় ব্যয় চালনার জন্য ন্যূনতম কৃষিজমি অথবা ন্যূনতম ব্যবসা অথবা চাকুরীর পর অতিরিক্ত যে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি থাকে তা থেকে হজ্জের ব্যয় নির্বাহ সম্ভব হলেই হজ হজ হবে। (গ) নিরাপত্তা। যাতায়াতের পথ নিরাপদ থাকা এবং রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা না থাকা।
(৫) হজ হজ হওয়ার জ্ঞান হওয়া, অবশ্য মুসলিম দেশে বসবাসকারীদের এ শর্তটি পরিবেশগত কারণে এমনিতেই অর্জিত হয়ে যায়। কেননা তাদের চোখের সামনে অনেককে হজ করতে দেখে, বিভিন্ন আলেম-ওলামা ও অন্যান্য মুসলমানের নিকট হজ-এর বিষয়ে আলোচনা শুনে থাকে।
(৬) হজ্জের সময় বা মৌসুম হওয়া। হজ্জের মৌসুম বলতে শাওয়াল, যিলক্বদ ও যিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনকে বুঝায় অথবা এমন সময়কে বুঝায় যখন থেকে রাষ্ট্রে হজ্জের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচিালিত হয়। কোন ব্যক্তির জীবনের কোন একটি বছরও উপরোক্ত শর্তগুলোর সমন্বয় ঘটলে তার উপর হজ হজ হয়ে যায়। সে যদি ঐ বছর হজ আদায় না করে থাকে এবং পরবর্তীকালে সামর্থ হারিয়েও ফেলে তবুও সে হজ ফরযের দায় থেকে মুক্ত হবে না। মহিলাদের হজ হজ হওয়ার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আরো ২টি শর্ত রয়েছে। যথা- () মহিলাদের সাথে স্বামী অথবা এমন কোন মাহরাম পুরুষ থাকা যার সাথে চিরস্থায়ীভাবে বিবাহ নিষিদ্ধ। কোন নারী যদি মাহরাম সঙ্গী ব্যতীত হজ করে তার হজ আদায় হবে, কিন্তু মাহরাম ব্যতীত সফরজনিত কারণে গোনাহ হবে। এক্ষেত্রে বদলি হজ করানোই উত্তম। () স্বামীর মৃত্যুজনিত কারণে বা তালাকের কারণে ইদ্দত পালনকালে নারীগণ হজ্জে গমন করবে না। হজ কখন আদায় করতে হয় কোন ব্যক্তি যখন হজ করবার সামর্থ লাভ করে তখন ঐ বছরই হজ আদায় করা কর্তব্য। অন্যথায় বিলম্বজনিত গোনাহগার হবে। বিলম্ব করে পরবর্তী কোন বছরে আদায় করলেও হজ হয়ে যাবে। কিন্তু অহেতুক বিলম্ব করা অনুচিত। কেননা হজ অনাদায়ী রেখে মৃত্যুবরণ করলে মারাত্মক গোনাহ হবে। হজ আদায়ের পূর্বে অসুস্থ হয়ে পড়লে এবং সুস্থ্য হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে তার জীবদ্দশায়ই বদলী হজ করানো উচিত। আর এ সুযোগও না পেলে ওয়ারিশগণের উচিত উক্ত ব্যক্তির বদলী হজ আদায় করে তাকে দায়মুক্ত করা। কেননা হজ সামর্থবান ব্যক্তির উপর আল্লাহ তায়ালার হক্ব। আল্লাহ বলেন- যে ব্যক্তি কাবাঘর পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ পায় তার উপর হজ আল্লাহ তায়ালার হক্ব। হাদীস শরীফে আছে- নবী করীম [সা.] বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘরে পৌঁছার জন্য পাথেয় ও বাহন পেল অথচ হজ আদায় করল না সে ব্যক্তি ইয়াহুদী অথবা খ্রীষ্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করুক তাতে আল্লাহর কিছু আসে যায় না। (তিরমিযী)

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীছে হজ আদায়ে বিলম্ব না করার প্রতি প্রত্যক্ষ নির্দেশ রয়েছে। প্রকৃত পক্ষে যারা আল্লাহ প্রেমিক তারাতো কাবা দর্শনের জন্য প্রতিটি মূহূর্তেই পাগলপারা হয়ে জীবনের প্রতিটি দিন অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে। হজ্জের সামর্থ আসার পর বিলম্ব করার কল্পনাও করতে পারেনা। মাবরুর হজের প্রতিদান জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়। যে হজ করল ও শরিয়ত অনুমতি দেয় না এমন কাজ থেকে বিরত রইল, যৌন-স্পর্শ রয়েছে এমন কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকল, সে তার মাতৃ-গর্ভ হতে ভূমিষ্ট হওয়ার দিনের মতো পবিত্র হয়ে ফিরে এল। আরাফার দিন এতো সংখ্যক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য কোনো দিন দেন না। এদিন আল্লাহ তাআলা নিকটবর্তী হন ও আরাফার ময়দানে অবস্থানরত হাজিদেরকে নিয়ে তিনি ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করেন, ও বলেন ওরা কী চায়?। সর্বোত্তম আমল কী এ ব্যাপারে এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ [সা.] কে জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে বললেন, ‘অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি ঈমান, ও তারপর মাবরুর হজ যা সকল আমল থেকে শ্রেষ্ঠ। সূর্য উদয় ও অস্তের মধ্যে যে পার্থক্য ঠিক তারই মত।

অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘উত্তম আমল কি এই মর্মে রাসুলুল্লাহ [সা.]-কে জিজ্ঞাসা করা হল। উত্তরে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান। বলা হল, ‘তারপর কী? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ। বলা হল তারপর কোনটি? তিনি বললেন, মাবরুর হজ। একদা রাসুলুল্লাহ [সা.]-কে প্রশ্ন করে আয়েশা (রা.) বলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমরা কি আপনাদের সাথে জিহাদে ও অভিযানে যাব না? তিনি বললেন, ‘তোমাদের জন্য উত্তম ও সুন্দরতম জিহাদ হল হজ, তথা মাবরুর হজ।” ‘হজ ও উমরা পালনকারীগণ আল্লাহর অফদ-মেহমান। তারা যদি আল্লাহকে ডাকে আল্লাহ তাদের ডাকে সাড়া দেন। তারা যদি গুনাহ মাফ চায় আল্লাহ তাদের গুনাহ মাফ করে দেন। আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ [সা.] বলেছেন, ‘এক উমরা হতে অন্য উমরা, এ দুয়ের মাঝে যা কিছু (পাপ) ঘটবে তার জন্য কাফফারা। আর মাবরুর হজের বিনিময় জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়।হাদিসে আরো এসেছে, রাসুলুল্লাহ [সা.] বলেছেন, ‘কারো ইসলাম-গ্রহণ পূর্বকৃত সকল পাপকে মুছে দেয়। হিজরত তার পূর্বের সকল গুনাহ মুছে দেয়, ও হজ তার পূর্বের সকল পাপ মুছে দেয়। ইবনে মাসউদ হতে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা পর পর হজ ও উমরা আদায় করো। কেননা তা দারিদ্র্য ও পাপকে সরিয়ে দেয় যেমন সরিয়ে দেয় কামারের হাপর লোহা-স্বর্ণ-রুপার ময়লাকে। আর হজ্জে মাবরুরের ছোয়াব তো জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়। উপরে উল্লেখিত হাদিসসমূহের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। তাই হজ পালনেচ্ছু প্রতিটি ব্যক্তিরই উচিত পবিত্র হজের এই ফজিলতসমূহ ভরপুরভাবে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে যাওয়া। হজ কবুল হওয়ার সকল শর্ত পূর্ণ করে সমস্ত পাপ ও গুনাহ থেকে মুক্ত থেকে কঠিনভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা।

হজের তাৎপর্য: ইসলামি ইবাদতসমূহের মধ্যে হজের গুরুত্ব অপরিসীম। এক হাদিস অনুযায়ী হজকে বরং সর্বোত্তম ইবাদত বলা হয়েছে। তবে হজের এ গুরুত্ব বাহ্যিক আচার- অনুষ্ঠান থেকে বেশি সম্পর্কযুক্ত হজের রুহ বা হাকীকতের সাথে। হজের এ রুহ বা হাকীকত নিুবর্ণিত পয়েন্টসমূহ থেকে অনুধাবন করা সম্ভব
১. এহরামের কাপড় গায়ে জড়িয়ে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে হজের সফরে রওয়ানা হওয়া কাফন পরে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে আখেরাতের পথে রওয়ানা হওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
২. হজের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেয়া আখেরাতের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেয়ার প্রয়োজনয়ীতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
৩. এহরাম পরিধান করে পুত-পবিত্র হয়ে আল্লাহর দরবারে হাজিরা দেয়ার জন্যলাব্বাইক বলা সমস্ত গুনাহ-পাপ থেকে পবিত্র হয়ে পরকালে আল্লাহর কাছে হাজিরা দেয়ার প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আরো স্মরণ করিয়ে দেয় যে এহরামের কাপড়ের মতো স্বচ্ছ-সাদা হৃদয় নিয়েই আল্লাহর দরবারে যেতে হবে।
৪.লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলে বান্দা হজ বিষয়ে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর যে কোনো ডাকে সাড়া দেয়ার ব্যাপারে সদা প্রস্তুত থাকার কথা ঘোষণা দেয়। এবং বাধাবিঘ্ন বিপদ-আপদ কষ্ট-যাতনা পেরিয়ে যে কোনো গন্তব্যে পৌঁছতে সে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, এ কথা ব্যক্ত করে।
৫. এহরাম অবস্থায় সকল বিধি-নিষেধ মেনে চলা স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে যে মুমিনের জীবন বন্ডাহীন নয়। মুমিনের জীবন আল্লাহর রশিতে বাঁধা। আল্লাহ যেদিকে টান দেন সে সেদিকে যেতে প্রস্তুত। এমনকী যদি তিনি স্বাভাবিক পোশাক- আশাক থেকে বারণ করেন, প্রসাধনী আতর স্নো ব্যবহার, স্বামী-স্ত্রীর সাথে বিনোদন নিষেধ করে দেন, তবে সে তৎক্ষণাৎ বিরত হয়ে যায় এসব থেকে। আল্লাহর ইচ্ছার সামনে বৈধ এমনকী অতি প্রয়োজনীয় জিনিসকেও ছেড়ে দিতে সে ইতস্তত বোধ করে না বিন্দুমাত্র।
৬. এহরাম অবস্থায় ঝগড়া করা নিষেধ। এর অর্থ মুমিন ঝগড়াটে মেজাজের হয় না। মুমিন ক্ষমা ও ধৈর্যের উদাহরণ স্থাপন করে জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে। মুমিন শান্তিপ্রিয়। ঝগড়া-বিবাদের ঊর্ধ্বে উঠে সে পবিত্র ও সহনশীল জীবন যাপনে অভ্যস্ত।
৭. বায়তুল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে মুমিন নিরাপত্তা অনুভব করে। কেননা বায়তুল্লাহকে নিরাপত্তার নিদর্শন হিসেবে স্থাপন করেছেন আল্লাহ তাআলা। সফরের কষ্ট-যাতনা সহ্য করে বায়তুল্লাহর আশ্রয়ে গিয়ে মুমিন অনুভব করে এক অকল্পিত নিরাপত্তা। তদ্রƒপভাবে শিরকমুক্ত ঈমানি জীবযাপনের দীর্ঘ চেষ্টা-সাধনার পর মুমিন আল্লাহর কাছে গিয়ে যে নিরাপত্তা পাবে তার প্রাথমিক উদাহরণ এটি।
৮. হাজরে আসওয়াদ চুম্বন-স্পর্শ মুমিনের হৃদয়ে সুন্নতের তাজিম-সম্মান বিষয়ে চেতনা সৃষ্টি করে। কেননা নিছক পাথরকে চুম্বন করার মাহাত্ব কী তা আমাদের বুঝের আওতার বাইরে। তবুও আমরা চুম্বন করি, যেহেতু রাসুলুল্লাহ [সা.] করেছেন। বুঝে আসুক না আসুক কেবল রাসুলুল্লাহ [সা.] এর অনুসরণের জন্যই আমরা চুম্বন করে থাকি হাজরে আসওয়াদ। এ চুম্বন বিনা-শর্তে রাসুলুল্লাহ [সা.] এর আনুগত্যে নিজেকে আরোপিত করার একটি আলামত। ওমর [রা.] হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করার পূর্বে বলেছেন, ‘আমি জানি নিশ্চয়ই তুমি একটি পাথর। ক্ষতি-উপকার কোনোটারই তোমার ক্ষমতা নেই। রাসুলুল্লাহ [সা.] কে চুম্বন করতে না দেখলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। হাজরে আসওয়াদের চুম্বন, তাই, যুক্তির পেছনে না ঘুরে, আল্লাহ ও রাসূলের নিঃশর্ত আনুগত্যের চেতনা শেখায় যা ধর্মীয় নীতি-আদর্শের আওতায় জীবনযাপনকে করে দেয় সহজ, সাবলীল।
৯. তাওয়াফ আল্লাহ-কেন্দ্রিক জীবনের নিরন্তর সাধনাকে বুঝায়। অর্থাৎ একজন মুমিনের জীবন আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে কেন্দ্র করে ঘোরে। এক আল্লাহকে সকল কাজের কেন্দ্র বানিয়ে যাপিত হয় মুমিনের সমগ্র জীবন। বায়তুল্লাহর চার পাশে ঘোরা আল্লাহর মহান নিদর্শনের চার পাশে ঘোরা। তাওহীদের আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের চার পাশে ঘোরা। তাওহীদনির্ভর জীবনযাপনের গভীর অঙ্গীকার ব্যক্ত করা। আর সাত চক্কর চূড়ান্ত পর্যায়কে বুঝায়। অর্থাৎ মুমিন তার জীবনের একাংশ তাওহীদের চার পাশে ঘূর্ণায়মান রাখবে আর বাকি অংশ ঘোরাবে অন্য মেরুকে কেন্দ্র করে, এরূপ নয়। মুমিনের শরীর ও আত্মা, অন্তর-বহির সমগ্রটাই ঘোরে একমাত্র আল্লাহকে কেন্দ্র করে যা পবিত্র কুরআনে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো বলে ব্যক্ত করা হয়েছে।
১০. আল্লাহ তাআলা নারীকে করেছেন সম্মানিতা। সাফা মারওয়ার মাঝে সাত চক্কর, আল্লাহর রহমত-মদদ কামনায় একজন নারীর সীমাহীন মেহনত, দৌড়ঝাঁপকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যে শ্রম-মেহনতের পর প্রবাহ পেয়েছিল রহমতের ফোয়ারা যমযম। সাত চক্করে সম্পূর্ণ করতে হয় সাঈ যা, স্মরণ করিয়ে দেয় যে আল্লাহর রহমত-সাহায্য পেতে হলে সাত চক্কর অর্থাৎ প্রচুর চেষ্টা মেহনতের প্রয়োজন রয়েছে। মা হাজেরার মতো গুটি গুটি পাথর বিছানো পথে সাফা থেকে মারওয়া, মারওয়া থেকে সাফায় দৌড়ঝাঁপের প্রয়োজন আছে। পাথুরে পথে সাত চক্কর, তথা প্রচুর মেহনত ব্যতীত দুনিয়া- আখেরাতের কোনো কিছুই লাভ হবার মতো নয় এ বিধানটি আমাদেরকে বুঝিয়ে দেয় পরিষ্কারভাবে।

Facebook Comment