প্রত্যেককে এই দুনিয়া ছেড়ে পরকালে পাড়ি দিতে হবে একথা যেমন সত্য তেমনি প্রতিটা মানুষকে পরকালে মুক্তি পাওয়ার জন্য সঠিক পথ বেছে নিতে হবে এটাও সত্য। পৃথিবীতে বহু জাতির মানুষ বহু পথ ও মত নিয়ে চলেছেন পরকালে মুক্তি পাওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা মুসলিমরা সেসব পথে চলতে পারিনা কেননা আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহ ও তার রাসুল (সাঃ) যে পথ দেখিয়েছেন সেটাই আসল পথ। কিন্তু দুঃখের বিষয় মুসলিমদের মাঝেও অনেক মত ও পথ আবিষ্কার হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে এতগুলো মত ও পথের মধ্যে আমরা কোন পথটি বেছে নেবো সেটাই আলোচ্য প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে। আমরা জানি দুনিয়া পরকালের কর্মক্ষেত্র। দুনিয়ায় মানুষের কাজের উপর ভিত্তি করেই আল্লাহ পরকালে জান্নাতে বা জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। পরকালে জাহান্নাম থেকে বেঁচে জান্নাত লাভ করাই চুড়ান্ত মুক্তি। আর সেই চুড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে প্রত্যেকের উচিৎ পবিত্র কোর’আন ও সহিহ হাদিস অনুযায়ী আমল করা। কোর’আন ও হাদিসে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার নির্দেশ থাকলেও মুসলমানগণ বিভিন্ন সময় আকিদাহ ও আমলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। আর সকল দলই নিজেদেরকে মুক্তিপ্রাপ্ত দল দাবী করছে এবং অন্যদেরকে পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করছে। এই মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ের ফায়সালা কোর’আন ও হাদিসের আলোকে আমাদেরকে গ্রহণ করা উচিৎ।
রাসুল (সাঃ) মুক্তিপ্রাপ্ত দলের নাম বলেননি। বরং তিনি মুক্তিপ্রাপ্ত দলের
বিভিন্ন গুণ ও বৈশিষ্ট বর্ণনা করেছেন। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“আমাদের জন্য রাসুল (সাঃ) নিজ হাতে একটা দাগ টানলেন, অতঃপর বললেন, এটা
আল্লাহতায়ালার সোজা ও সঠিক রাস্তা। অতঃপর তার ডানে ও বামে আরো কিছু দাগ টানলেন।
তারপর বললেন, এগুলি অন্য রাস্তা যাদের প্রত্যেকটার শুরুতে শয়তান বসে মানুষদেরকে
তার দিকে ডাকছে। তারপর আল্লাহর বাণী পড়লেন, ‘এটাই আমার সোজা ও সঠিক রাস্তা। সুতরাং
তোমরা অবশ্যই এর অনুসরণ করবে এবং অন্যান্য রাস্তাসমূহের অনুসরণ করোনা, তাহলে এ রাস্তাসমূহ
তোমাদেরকে তার রাস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। তিনি এভাবেই তোমাদেরকে নির্দেশ
দিলেন, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো’ (সুরা আন’আম, ১৫৩)।” (আহমাদ; নাসাঈ; হাকিম;
মিশকাত, ১৬৬; তাফসীরে ইবনে কাছীর সুরা আন’আমের ১৫৩ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)
এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুক্তির জন্য একটি সঠিক রাস্তা ছাড়াও শয়তানের
তৈরি বিভিন্ন ভ্রান্ত রাস্তা থাকবে। অন্য হাদিসে রাসুল (সাঃ) উম্মতে মুহাম্মাদীর
বিভক্তির কথা উল্লেখ করে মুক্তিপ্রাপ্তদের বর্ণনা দিয়ে বলেন, “নিশ্চয়ই বনী
ইসরাঈলরা ৭১ দলে বিভক্ত হয়েছিলো। তাদের মধ্যে ৭০ দল ধ্বংস হয়ে গেছে এবং একটি দল
নাজাত পেয়েছে। আর আমার উম্মত অচিরেই ৭২ দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে ৭১ দল
ধ্বংস হবে (জাহান্নামে যাবে) এবং একটি দল মুক্তিপ্রাপ্ত হবে। সাহাবাগণ বললেন,
মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি? রাসুল (সাঃ) বললেন, তারা একটি দল, তারা একটি দল”। (মুসনাদে
আহমাদ, ২৫০১; সিলসিলা ছয়িহাহ, ২০৪, সনদ হাসান)
অন্য হাদিসে রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “ওহে, অবশ্যই তোমাদের পূর্বে আহলে কিতাবগণ
(ইহুদী ও নাসারা) ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিলো। আর নিশ্চয়ই এই উম্মত অচিরেই ৭৩ দলে
বিভক্ত হবে। তন্মধ্যে ৭২ দল জাহান্নামী ও একদল জান্নাতী। জান্নাতীরা হলো একটি জামা’আত
বা দল”। (আহমাদ, ১৬৯৭৯; ইবনে মাজাহ, ৩৯৯২; মিশকাত, ১৭২)
উপরোক্ত হাদিস দু’টি থেকে স্পষ্ট বুঝা গেলো যে, মুসলমানদের মধ্যেই ৭২ টি বা
৭৩ টি দল হবে। তন্মধ্যে ৭১টি বা ৭২ টি দলই জাহান্নামে যাবে এবং একটি দল জান্নাতে
যাবে। সেটিই মূলতঃ মুক্তিপ্রাপ্ত দল। অন্য হাদিসে রাসুল (সাঃ) হকপন্থী দল প্রসঙ্গে
বলেন, “আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল সর্বদা হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, বিরোধীরা বা
পরিত্যাগকারীরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, এই অবস্থায় কিয়ামত এসে যাবে, তারা
ঐ অবস্থায়ই থাকবে”। (বুখারী, ৩৯৯২; মুসলিম ‘ইমারত’ অধ্যায়, ১৯২০)
বর্তমানে সকল নামধারী ইসলামি দলই এই হাদিসগুলোকে উল্লেখ করে নিজেদেরকে
মুক্তিপ্রাপ্ত দল বলার চেষ্টা করে। আর বিরোধী দলকে পথভ্রষ্ট ৭১ বা ৭২ দলের
অন্তর্ভূক্ত বলে প্রচার করে। কিন্তু আসলে মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি?
রাসুল (সাঃ) স্বীয় সাহাবীদের সম্মুখে মুক্তিপ্রাপ্ত দলের কথা বর্ণনা করলে
তারা রাসুল (সাঃ)-কে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ), মুক্তিপ্রাপ্ত দল
কোনটি? রাসুল (সাঃ) সাহাবীদের প্রশ্নের যে উত্তর দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে দু’টি
বর্ননা পাওয়া যায়।
প্রথম বর্ণনাঃ রাসুল (সাঃ) মুক্তিপ্রাপ্ত দল সম্পর্কে বলেছেন, “এটা হলো
একটা দল”। (তাহকিক মিশকাত, ১৭২, সনদ সহিহ, ‘কিতাব ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ)
এ হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়না যে, মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি। তাই এই
অস্পষ্টতাকে পুঁজি করে অনেক দলই বলে থাকে, এখানে যেহেতু জামা’আত বা দলের কথা বলা
হয়েছে সেহেতু জামা’আত যত বড় হবে তারাই হবে মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অধিকারী। দলিল
হিসেবে একটি যীফ হাদিস পেশ করে যে, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা বড় জামা’আতের
পায়রাবী করো”। (হাদিসটি যঈফ, তাহকিক মিশকাত হা/১৭৪ এর টিকা ‘ঈমান’ অধ্যায়)। ইবনে মাজাহতে
আনাস (রাঃ) কর্তৃক এ সম্পর্কিত একটি হাদিস বর্ণিত
হয়েছে, সে হাদিসটিও যঈফ। (যঈফ ইবনে মাজাহ, ৭৮৮; সিলসিলা যঈফা, ২৮৯৬)
জামা’আতের উপরোক্ত ব্যাখ্যা ঠিক নয়। এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করার আগে আমাদেরকে জামা’আতের
সঠিক সংজ্ঞা জানা দরকার। মূলতঃ জামা’আতের জন্য লোক বেশি হওয়া শর্ত নয়, হকের
অনুসারী হওয়াই শর্ত। জামা’আতের সংজ্ঞায় প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ
(রাঃ) বলেন, “জামা’আত হচ্ছে হকের অনুগামী হওয়া, যদিও তুমি একাকী হও”। (ইবনু
আসাকির, তারীখু দিমাশক ১৩/৩২২ পৃঃ সনদ সহিহ; তাহকীক মিশকাত, ১৭৩, ১/৬১ পৃঃ)
যেমন আল্লাহপাক নিজেই জামা’আতের সংজ্ঞার উদাহরণ দিতে গিয়ে ইবরাহীম (আঃ)-কে
একটি দল বলেছেন। আল কোর’আনে আল্লাহতায়ালা বলেন,
إِنَّ
إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِّلَّهِ حَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ
الْمُشْرِكِينَ
“নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর হুকুম পালনকারী একটি উম্মত
(দল) বিশেষ এবং তিনি মুশরীকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না” (সুরা নাহল, ১২০)।
এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইবরাহীম (আঃ)-কে ‘উম্মত’ বা জাতি (দল) বলে ঘোষণা
দিয়েছেন, যদিও তিনি ছিলেন একা। এখানে আল্লাহ সংখ্যাধিক্যের দৃষ্টিতে নয় ব্রং হকের
উপরে থাকার কারণে ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রশংসা করেছেন।
“আব্দুল্লাহ বিন মুবারক (রঃ)-কে জামা’আত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি
বলেন, আবু বকর ও ওমর (রাঃ), তাকে বলা হলো, তারাতো ইন্তিকাল করেছেন। তিনি বললেন,
তাহলে অমুক অমুক। তাকে বলা হলো, তারাও তো মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন তিনি বললেন, আবু
হামযা আস সুকরী হলো জামা’আত। অর্থাৎ একজন নেক ফাযেল ব্যক্তি সুন্নাত ও সালফে
সালেহীনের পথের অনুসারীই হচ্ছেন জামা’আত ও আহলে হকের মানুষ। সুতরাং সংখ্যাধিক্য
এখানে বিবেচ্য নয়। বরং লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে সুন্নাতের অনুসারী হওয়া এবং বিদ’আত
পরিত্যাগ করা।” (ডঃ নাছের বিন আব্দুল করীম আল আকল, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের
পরিচিতি, অনুঃ মুহাম্মদ শামাউন আলী, ঢাকাঃ ইসলামি ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংস্থা, জানুয়ারী
১৯৯৭, পৃঃ ৬৪)
সুতরাং হকের অনুসারী একজন হলেও সে বড় দলের অন্তর্ভূক্ত। সংখায় অধিক হলেই বড়
দল বা জামা’আতে হক নয়। অনুরূপভাবে সংখ্যাধিক্য দেখে বড় দলের অনুসরণ করলেই হকপন্থী
হওয়া যায়না। বরং পবিত্র কোর’আন ও সহিহ হাদিসের নিঃশর্ত অনুসরণ করাই প্রকৃত অর্থে
হকপন্থী হওয়ার পূর্বশর্ত। এই হকপন্থীগণই হলেন বড় জামা’আত। আর তারা হলেন সাহাবায়ে
কিরাম, সালফে সালেহীন ও তাদের যথাযথ অনুসারীগন। সুতরাং যারা খুলাফায়ে রাশেদীন ও
সাহাবায়ে কিরামের মাসলাক অনুসরণে পবিত্র কোর’আন ও সহিহ হাদিস অনুযায়ী আমল করবেন,
তারাই বড় জামা’আতের অন্তর্ভূক্ত হবেন। অতএব নিঃশর্তভাবে পবিত্র কোর’আন ও সহিহ
হাদিস অনুযায়ী আমল করতে পারলে সংখ্যায় কম হলেও তারাই হবে নাজাতপ্রাপ্ত দল।
পক্ষান্তরে সংখ্যায় বেশি হলেও সেখানে কোর’আন ও হাদিস মোতাবেক সঠিক আমল না থাকলে
সেটা হকপন্থী ও নাজাতপ্রাপ্ত দল নয়।
অনেক সময় কোন দলে লোকসংখ্যা বেশি দেখে মানুষ মনে করে ঐ দলের লোকেরাই হকের
পথে আছে। তাদের ধারণা এত লোক মিলে কি ভূল পথে যেতে পারে? আর আমরা হকপন্থী হলে
আমাদের সংখ্যা কম কেন? আবার অনেকে বলেও থাকেন, দশজন যেখানে আল্লাহও সেখানে। এ
ধারণা মোটেই ঠিক নয়। এরকম কথা কোর’আন ও সুন্নাহ বিরোধী। তাছাড়া হকপন্থী হওয়ার জন্য
সংখ্যায় বেশি হওয়া শর্ত নয়, বরং বাতিলের সংখ্যা হকপন্থীদের তুলনায় বেশি হবে এটাই
স্বাভাবিক। যেমন রাসুল (সাঃ) হক দল মাত্র ১ টি আর বাতিল দল ৭২ টির কথা বলেছেন। অর্থাৎ
রাসুলের (সাঃ) উম্মতের ৭৩ দলের মধ্যে ৭২ দলই জাহান্নামী আর একটিই জান্নাতী। সুতরাং
হকপন্থীদের সংখ্যা কম হবে এটাই রাসুলের ভাষ্য।
সাধারনভাবে কোনো দলে লোক বেশি থাকাই বাতিল দল হওয়ার প্রমাণ। কারণ রাসুল
(সাঃ)-এর উম্মতের ৭৩ টি দলের মধ্যে ৭২ টি দলই জাহান্নামে যাবে। সুতরাং বাতিলদের
সংখ্যা বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক।
এক্ষেত্রে বাকি সঠিক একটি দলকে খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী আমল করতে হবে। আর মানুষ
সাধারণত এ বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় না; বড় দল ও সংখ্যা বেশি দেখে তাদের অনুসরণ করে।
এজন্য দিন দিন বাতিলের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
আমরা যদি পৃথিবীর জনসংখ্যার দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে, পৃথিবীর মোট
জনসংখ্যার মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ মুসলমান। যদি সংখ্যাই হকপন্থী হওয়ার শর্ত হয়,
তাহলে ধরে নিতে হবে বিধর্মীরাই হকের পথে আছে বরং মুসলমানরাই বাতিল পথে আছে। অথচ
কোনো মুসলিমও তা স্বীকার করবে না, মেনেও নেবে না। হক বাতিলের মানদন্ড আল্লাহ ও তার
রাসুল (সাঃ) সংখ্যার দ্বারা নির্ধারণ করেননি বরং নিঃশর্তভাবে অহি’র অনুসরণ করাই
হলো হকপন্থী হওয়ার শর্ত।
আল্লাহপাক বলেন,
وَلَقَدْ
ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِي هَٰذَا الْقُرْآنِ مِن كُلِّ مَثَلٍ لَّعَلَّهُمْ
يَتَذَكَّرُونَ
“আমি এ কোর’আনে মানূষের জন্য সব দৃষ্টান্তই বর্ণনা করেছি, যাতে তারা উপদেশ
গ্রহণ করে” (আয যুমার, ২৭)।
মহান আল্লাহপাক কোর’আনের প্রায় সব জায়গায় বলেছেন, অধিকাংশরাই মূর্খ, অধিকাংশরাই কাফের, অধিকাংশরাই ফাসেক, অধিকাংশরাই গাফেল, অধিকাংশরাই জাহান্নামী ইত্যাদি। অর্থাৎ ‘অধিকাংশ’ কথাটির মাধ্যমে খারাপের দিকে ঝোক দিয়েছেন। যেমন আল্লাহতায়ালার বাণী,
“তাদের অধিকাংশই জানেনা” (আন’আম ৩৭; আরাফ ১৩১; আনফাল ৩৪; ইউনুস ৫৫; নাহল
৩৮, ৭৫, ৮৩, ১০১; নামল ৬১, ৭৩; কাসাস ১৩, ৫৭; আনকাবুত ৬৩; দুখান ৩৯; হুজুরাত ৪;
তুর ৪৭ ইত্যাদি)।
“তাদের অধিকাংশই ফাসিক” (হাদীদ ১৬, ২৬, ২৭; মায়েদাহ ৮১ ইত্যাদি)।
“নিশ্চয়ই অধিকাংশ মানুষ আমার আয়াত সম্পুর্কে ফাফেল” (ইউনুস ৩৬, ৯২
ইত্যাদি)।
তাছাড়াও বিভিন্ন সুরার বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহপাক অধিকাংশ লোকের নিন্দা করেন।
যেমন, ইউনুস ১০৩; সাফফাত ৭১; আস শুয়ারা ৮, ৬৭, ১০৩, ১২১, ১৩৯, ১৫৮, ১৭৪, ১৯০, ২২৩;
আরাফ ১৭, ১০২; গাফির ৫৯; যুখ্রুফ ৭৮; ফুসসিলাত ৪; নামল ৭৩; রুম ৬, ৪২; সাবা ৩৬,
৪১; বাকারা ১০০; মুমিনুন ৭০; ইসরা ৮৯; ফুরকান ৫০; রাদ ১; মায়েদাহ ১০৩ ইত্যাদি।
এছাড়াও বেশি সংখ্যক লোকদের অবস্থা কি হবে তাও আল্লাহপাক স্পষ্টভাবে জানিয়ে
দিয়েছেন। আল্লাহপাক বলেন,
وَلَقَدْ
ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِّنَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ ۖ
لَهُمْ قُلُوبٌ لَّا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَّا يُبْصِرُونَ بِهَا
وَلَهُمْ آذَانٌ لَّا يَسْمَعُونَ بِهَا ۚ
أُولَٰئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ ۚ
أُولَٰئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ
“আর আমি অধিকাংশ জ্বীন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের
অন্তর রয়েছে, তা দ্বারা তারা উপলদ্ধি করে না। তাদের চোখ রয়েছে, তা দ্বারা তারা
দেখে না। আর তাদের কান রয়েছে, তা দ্বারা তারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো,
বরং তাদের চেয়েও বিভ্রান্ত। তারাই হলো গাফেল” (আল আরাফ, ১৭৯)।
আল্লাহপাক এবার ‘অধিকাংশ’ লোকেরদের ব্যাপারে আল কোর’আনে পরিষ্কারভাবে বলেন,
وَإِن
تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۚ
إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ
“আর যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নে, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর
পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে। তারা শুধু অলীক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ
অনুমান ভিত্তিক কথাবার্তা বলে থাকে” (সুরা আন’আম, ১১৬)।
অপরদিকে আল্লাহতায়ালা ‘কম’ সংখ্যক লোকেরদের প্রশংসা করেছেন। আল কোর’আনে
আল্লাহপাক অনেক আয়াতে বলেছেন,
“আমার বান্দাদের মধ্যে কম সংখ্যকই শোকরগুজার” (সাবা, ১৩ ইত্যাদি)।
“তোমরা অল্প সংখ্যক লোকই শুকরিয়া আদায় করো” (আরাফ ৪, ১০ ইত্যাদি)।
“তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ করো” (হাক্কাহ ৪১, ৪২ ইত্যাদি)।
তাছাড়াও অন্যান্য আয়াতেও আল্লাহপাক ‘অল্প সংখ্যক’ লোকের খুবই প্রশংসা করেন।
রাসুলও (সাঃ) অল্পসংখ্যক লোকদেরকে সুসংবাদ প্রদান করেছেন। আবু বকর (রাঃ)
হতে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “ইসলাম শুরু হয়েছিলো গুটিকতক (অল্পসংখ্যক) লোকের
মাধ্যমে, আবার সেই অবস্থাপ্রাপ্ত হবে। অতএব সুসংবাদ সেই অল্পসংখ্যক লোকদের জন্য”
(মুসলিম, ১৪৫; মিশকাত ১৫৯ ‘কোর’আন ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ)। আর এই অল্প
সংখ্যক হকপন্থী লোকদের কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা, তাদেরকে নিশ্চিহ্নও করতে
পারবে না। তারা সংখ্যায় কম হলেও কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
দ্বিতীয় বর্ণনাঃ রাসুল (সাঃ) মুক্তিপ্রাপ্ত দলের পরিচয় প্রসঙ্গে অন্য
হাদিসে বলেন, “মুক্তিপ্রাপ্ত দল হচ্ছে আমি ও আমার সাহাবীগণ যে পথের উপর আছি।”
(সহিহ তিরমিজী, ২১২৯; সিলসিলা ছহীহাহ ১৩৪৮; হাকেম ১/১২৯; আহমাদ বিন হাম্বল,
সুন্নাতের মূলনীতি, বাংলায় ইসলাম (ইংল্যান্ড দ্বিতীয় সংস্করন, এপ্রিল ২০০২), পৃঃ
২৪)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, “আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। একটি দল ছাড়া সবাই
জাহান্নামে যাবে। জিজ্ঞেস করা হলো, তারা কারা হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বললেন, ‘যারা
আমার ও আমার সাহাবীদের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত।” (তিরমিজী, ২৬৪১; মিশকাত, ১৭১;
সিলসিলা ছহীহাহ, ১০৪৮)।
এই হাদিসেও রাসুল (সাঃ) মুক্তিপ্রাপ্ত কোনো দলের নাম বলেননি, বরং বৈশিষ্টের
কথা উল্লেখ করেছেন। রাসুল (সাঃ) কোনো দলের নাম বললে সবাই সেই দলের অনুসারী বলেই
দাবী করতো। এজন্যে রাসুল (সাঃ) বৈশিষ্টের কথা বলেছেন, যাতে পবিত্র কোর’আন ও সহিহ
হাদিসের উপরে আমল করার মাধ্যমে রাসুলের উদ্দিষ্ট দল তৈরি হয়।
হাদিসের আলোকে মুক্তিপ্রাপ্ত দলের বৈশিষ্ট হলো, রাসুল (সাঃ) ও তার সাহাবীগণ
যে পথের অনুসারী ছিলেন সে পথের অনুসরণ করা। কোর’আনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহর
অনুসরণের পাশাপাশি তার রাসুলের অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
قُلْ
أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ ۖ فَإِن تَوَلَّوْا
فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ
“আপনি বলুন, তোমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের অনুসরণ করো, যদি তারা মুখ ফিরিয়ে
নেয়, তবে জেনে রাখো নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদের ভালোবাসেন না” (আল ইমরান, ৩২)। এছাড়াও
সুরা নিসা ১৩-১৪, ৬০-৬১, ৭৯-৮০; মায়েদাহ ৯২; আনফাল ২৪, ৪৬; নাহল ৪৪; নুর ৬৩
ইত্যাদি আয়াতে এ বিষয়ে আলোচনা এসেছে।
এবার দেখুন স্বয়ং আল্লাহতায়ালার উপদেশ। আল্লাহ বলেন,
يَا
أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي
الْأَمْرِ مِنكُمْ ۖ فَإِن تَنَازَعْتُمْ
فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ
بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ
وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
“তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়ো, তাহলে তা আল্লাহ ও
তার রাসুলের প্রতি প্রত্যার্পণ করো যদি তোমরা আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী
হয়ে থাকো। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম” (সুরা নিসা, ৫৯)।
রাসুলও (সাঃ) বিভিন্ন হাদিসে তার অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষত
মতপার্থক্যের সময় রাসুলের ও খুলাফায়ে রাশেদীনের অনুসরণের নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন,
“তোমাদের মধ্যে থেকে যারা জীবিত থাকবে, তারা অচিরেই অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। অতএব
(মতভেদের সময়) আমার সুন্নাত এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের
অনুসরণ করা হবে তোমাদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। এ সুন্নাতকে খুব মজবুতভাবে মাড়ির
দাঁত দিয়ে আঁকড়ে ধরে থাকো। আর সমস্ত বিদ’আত থেকে বিরত থাকো। কেননা প্রত্যেকটি
বিদ’আতই গুমরাহী” (আবু দাঊদ, ৪৬০৭; তিরমিজী, ২৬৭৬; ইবনে মাজাহ, ৪২৪৪; আহমাদ,
১৬৬৯৪; ইবনু খুযায়মা, ‘জুম’আ’ অধ্যায় ১৭৮৫; মিশকাত, ১৬৫; রিয়াদুস সালেহীন, ১৫৭)।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, যখন মতবিরোধ দেখা দেবে তখন তোমরা
আমার সুন্নাতের অনুসরণ করবে। আর আমার সাহাবীগণ আমাকে যেভাবে অনুসরণ করেছে, যেভাবে
আমল করেছে, যে আকিদাহ পোষণ করেছে, তোমরা সেভাবেই আমার অনুসরণ করবে। সাথে সাথে
বিদ’আত তথা ইসলামের নামে নব আবিষ্কৃত বিষয় থেকে দূরে থাকবে। আজকের দিনে এই
মতবিরোধপূর্ণ সমাজে যদি আমরা রাসুল (সাঃ)-এর অনুসারী হতে পারি এবং সাহাবীগণ যেভাবে
কোর’আন ও হাদিসকে বুঝেছেন ও আমল করেছেন সেভাবে বুঝতে ও আমল করতে পারি, তাহলেই
আমাদের মধ্যে ঐক্য সম্ভব।
এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, রাসুল (সাঃ)-এর মৃত্যুর পূর্বেই আল্লাহপাক
ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। সুতরাং ইসলামের মধ্যে কম বেশি করার অধিকার কাউকে
দেওয়া হয়নি। বিদায় হজ্জের দিনে আল্লাহপাক নাযিল করলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য
তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং
ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম” (সুরা মায়েদাহ, ৩)।
অন্যত্র আল্লাহপাক বলেন,
وَمَن
يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ
مِنَ الْخَاسِرِينَ
“কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন গ্রহন করতে চাইলে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে
না এবং কিয়ামতের দিন সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে” (আল ইমরান, ৮৫)।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইহুদী নাসারাদের মতো মুসলমান নামধারী কিছু লোক
পবিত্র কোর’আনকে পরিবর্তন করতে না পারলেও কোর’আনের অপব্যাখ্যা করছে। রাসুলের (সাঃ)
নামে অসংখ্য জাল হাদিস তৈরি করছে। কিন্তু আল্লাহর কিছু বান্দা তাদের চক্রান্তের
মোকাবিলায় হাদিস বাছাই করে আমাদের সামনে সহিহ হাদিসগুলি তুলে ধরেছেন। আমাদের উচিৎ
কোর’আনের সঠিক ব্যাখ্যা ও সহিহ হাদিস গ্রহণ করা। তাহলে আমাদের মাঝে মতভেদ,
মতপার্থক্য থাকবে না। আল্লাহপাক কোর’আনে সব সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
وَلَا
يَأْتُونَكَ بِمَثَلٍ إِلَّا جِئْنَاكَ بِالْحَقِّ وَأَحْسَنَ تَفْسِيرًا
“তারা তমার নিকট এমন কোনো সমস্যা উপস্থিত করতে পারেনি, যার সমাধান ও সুন্দর
ব্যাখ্যা আমি তোমাকে দান করিনি” (ফুরকান, ৩৩)।
আল্লাহপাক কোর’আনে আরো বলেছেন,
وَلَقَدْ
ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِي هَٰذَا الْقُرْآنِ مِن كُلِّ مَثَلٍ لَّعَلَّهُمْ
يَتَذَكَّرُونَ
“আমি এ কোর’আনে মানুষের জন্য সব দৃষ্টান্তই বর্ণনা করেছি, যাতে তারা উপদেশ
গ্রহণ করে” (আয যুমার, ২৭)।
রাসুল (সাঃ) প্রদত্ত কোর’আনের ব্যাখ্যা ও তার বাস্তব জীবনই হলো হাদিস বা
সুন্নাহ। আর এই কোর’আন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমেই রাসুল (সা;) ও তার
সাহাবীদের অনুসরণ করা হবে এবং মতবিরোধপূর্ণ সময়ে সথিক পথ পাওয়া যাবে। বিদায় হজ্জের
দীর্ঘ ভাষণের এক পর্যায় রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “আমি তোমাদের নিকট যা রেখে যাচ্ছি তা
মজবুতভাবে ধরে থাকলে, আমার পরে কখনো তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না; আর সেটা হলো আল্লাহর
কিতাব” (মুসলিম; বাংলা মিশকাত ‘মানাসিক’ অধ্যায় ‘বিদায় হজ্জের ভাষণ’ অনুচ্ছেদ,
২৪৪০)।
এখানে কিতাবুল্লাহ বা আল্লাহর কিতাব বলতে শুধু কোর’আনকে ধরে রাখার কথা বলা
হয়নি। হাদিসও মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। কেননা কিতাবুল্লাহ বলতে কোর’আন ও হাদিসকে
বুঝায়। অন্য হাদিসে
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ব্যাখ্যা করে
বলেন, “আমি তোমাদের নিকট দু’টি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি; যতদিন তোমরা ঐ দু’টি বস্তুকে
মজবুতভাবে ধরে থাকবে, ততোদিন পথভ্রষ্ট হবে না। সে দু’টি বস্তু হলো, আল্লাহর কিতাব
ও তার নবীর সুন্নাত” (হাকেম, ১/৯৩; মুওয়াত্তা ‘কদর’ অধ্যায়; মিশকাত, ১৮৩)।
এ হাদিসে রাসুল (সাঃ) গোমরাহী থেকে বাঁচার জন্য দু’টি বস্তুকে আঁকড়ে ধরার
নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে রাসুল (সাঃ) তাকীদ দিয়ে বলেছেন যে, আমার উম্মত দু’টি জিনিস
আঁকড়ে ধরলে কখনো বিভ্রান্ত হবে না।
সাহাবীগন ও সালফে সালেহীনগণ স্ত্যের পথে থাকার জন্য ও মুক্তিপ্রাপ্ত দলের
অন্তর্ভূক্ত হওয়ার জন্য সুন্নাতের একনিষ্ঠ অনুসরণ করেছেন এবং অন্যকে অনুসরণের
নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন-
ক) আলী (রা;) ও আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন, “আমল ব্যতীত কোনো কথা
উপকারে আসবে না, কোনো আমলও কথা ব্যতীত উপকারে আসবে না। কোনো কথা ও আমল নিয়্যেত
ব্যতীত উপকারে আসবে না, আর কোনো নিয়্যেতও উপকারে আসবে না সুন্নাতের আনুকূল্য
ব্যতীত”। (আজুররী, কিতাবুশ শরী’আত, প্ররঃ ১২৩। গৃহীতঃ বায়হাকী আল খুতাস সালীমাহ ফী
বায়ানী উজুবি ইত্তিবাইস সুন্নাহ আল কারীমা, পৃঃ ৫)।
খ) উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) বলেছেন, “তোমরা সঠিক পথ ও সুন্নাত অবধারিত করে
নাও”। (শরহু উছুলিল ইতিকাদি আহলিস সুন্নাহ, ১/৫৬; আল খুতাস সালীমাহ ফী বায়ানী
উজুবি ইত্তিবাইস সুন্নাহ আল কারীমা, পৃঃ ৬)।
গ) প্রখ্যাত তাবেঈ যুহরী (রঃ) বলেন, “আমাদের আলিমদের মধ্য হতে যারা অতীত
হয়েছেন, তারা বলতেন সুন্নাতকে ভালোভাবে আঁকড়ে ধরা মুক্তিস্বরূপ (রক্ষাকবচ)।”
সুনানুদ দারেমী, মুকাদ্দামাহ, আছার নং ৯৬, সনদ সহিহ)।
ঘ) ইমাম মালেক (রঃ) বলেছেন, “সুন্নাত হলো নূহ (আঃ)-এর নৌকা সদৃশ। যে তাতে
আরোহণ করবে সে পরিত্রাণ পাবে। আর যে তা থেকে পিছে অবস্থান করবে সে ধ্বংস হয়ে
যাবে।” (আল খুতাস সালীমাহ ফী বায়ানী উজুবি ইত্তিবাইস সুন্নাহ আল কারীমা, পৃঃ ৬)।
ঙ) আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) বলেছেন, “জয়যুক্ত দল হলো কোর’আন ও সহিহ
হাদিসের অনুসারী।” (তার নিজস্ব গ্রন্থঃ গুনিয়াতুত তালেবীন)।
(জায়গা সংকুলানের জন্য আর যুক্ত করা হলো না)
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, মুক্তিপ্রাপ্ত দল হওয়ার জন্য রাসুল
(সাঃ)-এর সুন্নাত ও তার সাহাবীদের সুন্নাতের উপর আমল করতে হবে। রাসুলকে (সাঃ) বাদ
দিয়ে বা তার সহিহ হাদিসের বিরোধিতা করে কোনো ইমাম, কোনো পীর বা কোনো দলের অন্ধ অনুসরণ
করা যাবে না। বর্তমান শতধাবিভক্ত সমাজে আমাদেরকে সঠিক দল খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে
পবিত্র কোর’আন ও সহিহ হাদিসের আশ্রয় নিতে হবে। অনেকে নিজেদেরকে কোর’আন ও সহিহ
হাদিসের অনুসারী বলে থাকেন। অথচ তাদের কাজগুলি সহিহ হাদিস বিরোধী। সুন্নাহ বিরোধী,
শিরকী, বিদ’আতী আমল করে কি মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভূক্ত হওয়া যায়? তাই প্রথমে
আকিদাহ ঠিক করতে হবে।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “ইসলাম শুরু হয়েছিলো অপরিচিতর মতো এবং আবার ফিরে
আসবে অপরিচিতর মতো যেমন শুরুতে ছিলো। সেই অপরিচিতর জন্যই রয়েছে সুসংবাদ” (মুসলিম, ১৪৫)।
এখানে ‘অপরিচিত’ বলতে ইসলামের শুরুতে নবীজী
(সাঃ) ও সাহাবাগণকে প্রথম প্রথম মানুষ তেমন পাত্তাই দিতো না। অথচ তারাই ছিলো
মুক্তিপ্রাপ্ত দল কিন্তু সকলের কাছে তারা ‘অপরিচিত’ ছিলো যদিও পরে সেটা প্রকাশ
পায়। তেমনি এখানে ‘অপরিচিত’ বলতে ইসলামের সঠিক অনুসারী মুক্তিপ্রাপ্ত দলের লোকেরা এমনভাবে
ইসলাম প্রচার করবে, যাদেরকে অন্যান্য দলগুলো তেমন গুরুত্ব দেবেনা। তারা উলটো
বেশিরভাগ লোকই ‘মুক্তিপ্রাপ্ত’ দলের লোকগুলোকেই বাতিল মনে করবে। আর নিজেরা ভাববে,
আমরাই সঠিকপথে আছি। অথচ তারা ঠিক পথে নেই। এভাবেই হকদলের লোকেরা অন্যদের কাছে
‘অপরিচিত’ হয়ে পড়বে। এরাই ‘মুক্তিপ্রাপ্ত দল’। নবীজী (সাঃ) সেই অপরিচিতদের জন্যই
সুসংবাদ দিয়েছেন। আজকের দিনে এই মতবিরোধপূর্ণ সমাজে যদি আমরা রাসুল (সাঃ)-এর
অনুসারী হতে পারি এবং সাহাবাগণ যেভাবে কোর’আন ও হাদিসকে বুঝেছেন ও আমল করেছেন
সেভাবে বুঝতে ও আমল করতে পারি, তাহলেই আমাদের মধ্যে ঐক্য সম্ভব।
‘মুক্তিপ্রাপ্ত
দল’ আল্লাহ ও তার রাসুল (সাঃ)-এর কথার বাইরে অন্য কারো অন্ধ অনুসরণ করেনা। রাসুল
(সাঃ) ছিলেন নির্দোষ (গুনাহ থেকে পবিত্র), মনগড়া কোনো কথা বলেননি। তিনি ছাড়া
অন্যান্য মানুষ যতোই বড় হোন না কেন ভূল করতে পারেন। কেউই ভূল ত্রুটির উর্ধে নন।
নাজাতপ্রাপ্ত দলের আরো একটি পরিচয় হলো, সর্বক্ষেত্রে তারা তাওহীদকে অগ্রাধীকার
দেয়। তাদের সব কথা ও কাজে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের একত্ববাদের বিকাশ ঘটে, কেবল
তারই ইবাদত করে, তার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করে এবং তারই উপর তাওয়াক্কুল করে।
ইবাদত বন্দেগী, বিচার আচার, লেনদেন একথায় জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম আল্লাহ প্রবর্তিত
শরীয়তের অনুবর্তীতায়ই সম্পাদন করে। এগুলোর উপর ভিত্তি করেই মূলতঃ সত্যিকারের ইসলাম
আদর্শ গঠিত হয়। তবে তাওহীদকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে শিরকের বিষয়টিকে অবহেলা করলে
চলবে না। অবশ্যই শিরককে বিতাড়িত করতে হবে জীবনের সকল ক্ষেত্র থেকে। বর্তমান
বিশ্বের অধিকাংশ দেশ প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য ও
ছোট বড় শিরকের সমস্যায় জর্জরিত। আলাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠিতকরণ কর্মসূচিকে স্বার্থক
করতে হলে অবশ্যই সেসব শিরক নির্মূল করতে হবে। কারণ তাওহীদের দাবীই হচ্ছে যাবতীয়
শিরক দূর করা। শিরকের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে না তুলে এবং তাওহীদকে প্সহচাতে
রেখে কোনো দলই আল্লাহর সাহায্য পেতে পারে না। পৃথিবীতে আগমনকারী সকল রাসুলই এসব
কথার উত্তম নিদর্শন। আমাদের প্রিয় নবীও (সা;) এর ব্যতিক্রম নন। তিনি নিজ জীবনে এ
সত্য প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাই আমাদের উচিৎ যেকোনো মুল্যে আল্লাহর কোর’আন ও
রাসুলের (সাঃ) সহিহ হাদিস দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা যাতে করে আমরা ‘মুক্তিপ্রাপ্ত দল’ বা
‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত’-এর অংশীদার হতে পারি। আর এটাই হলো ‘নাজাত প্রাপ্ত
দল’।