ইসলামে সুন্নাতী পোষাক কোনটি তা নির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি। কারন সবদেশের আবহাওয়া ও পোষাক এক হওয়ার কথা নয়। তবে ইসলাম পোষাকের যে মূলনীতির কথা বলেছে ঢিলেঢালা জামা ও টুপি সেই মূলনীতির মধ্যে পড়ে যায়। মাথা ঢাকা বা টুপি পরা বৈশিষ্ট ও সৌন্দর্য। (বুখারী, ১১৯৮ ও ৩৮৫ এর অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা; আলোচনা দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ ২৫৩৮, ৬/৫১ পৃঃ)
পোষাকের মূলনীতিগুলো হলঃ
১। “পোষাক পরিধানের উদ্দেশ্য থাকবে দেহকে
আবৃত করা, যেন পোষাক পরা সত্বেও লজ্জাস্থান সমূহ অন্যের চোখে প্রকাশ না হয়ে ওঠে”
(মুসলিম; মিশকাত, ৩৫২৪)।
২। “ভিতরে বাইরে তাকওয়াশীল হতে হবে। এজন্য
ঢিলেঢালা, ভদ্র ও পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করতে হবে। হাদিসে সাদা পোষাক পরিধানের নির্দেশ এসেছে” (সুরা আরাফ, ২৬; মুসলিম; তিরমিজী; মিশকাত
৫১০৮, ৪৩৫০, ৪৩৩৭)।
৩। “পোষাক যেন অমুসলীমদের সাদৃশ্য না হয়”
(আহমাদ; আবু দাঊদ; মিশকাত, ৪৩৪৭)।
৪। “পুরুষরা রেশম কাপড়ের পোষাক পরিধান করতে
পারবে না” (সহীহ নাসাঈ, ৫২৬৫; মিশকাত, ৪৩৪১)।
৫। “পোষাক যেন টাখনুর নিচে না যায়” (নাসাঈ,
৫৩৩১)
৬। “পুরুষের পোষাক মহিলার পোষাকের এবং
মহিলার পোষাক পুরুষের পোষাকের সাদৃশ্যপূর্ণ না হয়” (আবু দাঊদ, ৪০৯৮; মিশকাত, ৪৪৬৯)।
৭। “অহংকার প্রকাশ করে এমন পোষাক হতে পারবে
না” (বুখারী, ৩৪৬৫; মুসলিম, ৯১)।
অনেকে, পুরুষদের প্যান্ট শার্ট পড়াটাকে
খারাপ মনে করে থাকে। সেটা ঠিক নয়। কেননা, সুন্নাতী পোষাক যেকোনো পোষাকই হতে পারে
যদি সেটা উপরোক্ত মূলনীতির শর্তগুলো পূরণ করে এবং ঢিলেঢালা, ভদ্র, পরিচ্ছন্ন ও
মাথায় টুপি থাকে। অনেকে বলে থাকেন প্যান্ট শার্ট অন্য ধর্মীদের পোষাক। এটাও ভূল।
কেননা, এগুলো সাধারণ পোষাক। স্থানভেদে অথবা আবহাওয়ার দরুণ পোষাক ভিন্নও হতে পারে।
সেরকম হলে তো শীতপ্রধান বা পাহাড়ি এলাকার লোক কখনো মুসলিম হতে পারে না। কেননা,
তাদের তো শীতবস্ত্র প্রায় সারা বছরই পরতে লাগে এবং সেখানকার পোষাকগুলোও সাধারণত
আলাদা হয়ে থাকে। তাই এগুলো সাধারণ পোষাক। তবে আমরা যে পোষাকই পরি না কেন উপরোক্ত
মূলনীতির শর্তগুলো পূরণ করতেই হবে। সে হিসেবে মুসলিমদের পোষাক মাথায় টুপিসহ
পাঞ্জাবী ও পাজামাই সবচেয়ে উত্তম।
মহান আল্লাহ নিজে সুন্দর, তিনি পছন্দও করেন
সুন্দর। আর তাই তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সুন্দর আকৃতিতে। অতঃপর এই সুন্দর
আকৃতির মানুষগুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তিনি সুন্দর পোষাকের ব্যবস্থা করেছেন।
আল্লাহপাক মহাগ্রন্থ আল কোর’আনে বলেছেন,
يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنزَلْنَا
عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا ۖ
وَلِبَاسُ التَّقْوَىٰ ذَٰلِكَ خَيْرٌ ۚ
ذَٰلِكَ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ
“হে আদমের সন্তানগণ! আমি তোমাদের জন্য পোষাক
পাঠিয়েছি, তোমাদের দেহের গোপনাঙ্গ আবৃত্ত ঢেকে রাখার জন্য এবং সৌন্দর্য বাড়ানোর
জন্য। সর্বোত্তম পোষাক হচ্ছে খোদাভক্তির পোষাক” (আল আরাফ, ২৬)।
ইসলাম পুরুষ ও নারীর পোষাক পরিচ্ছদ সম্বন্ধে
যথাযথ উপদেশ ও নির্দেশনা দান করেছে। ইসলাম যথোপযুক্ত পোষাকের মাধ্যমে দুটি বিষয়
প্রতিষ্ঠা করতে চায়। প্রথমতঃ মানবদেহ ঠিকমতো আচ্ছাদন করা। কারন বিশ্রীভাবে দেহ
সৌষ্ঠভ প্রদর্শন ঠিক নয়। দ্বিতীয়তঃ সৌন্দর্যায়ন ও ভূষণ বাড়িয়ে তোলা। শরীর ঠিকমতো
ঢেকে রাখা ও ভূষণের মধ্যে ভারসাম্য থাকা উচিৎ। যদি এই ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে যায়
তাহলে শয়তানের পথ অনুসরন করা হবে। এসম্পর্কে কোর’আন পাকে ইরশাদ হয়েছে,
يَا بَنِي آدَمَ لَا
يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُم مِّنَ الْجَنَّةِ
يَنزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْآتِهِمَا ۗ
إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ۗ
إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيَاطِينَ أَوْلِيَاءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ
“ওহে আদম সন্তানগণ শয়তান তোমাদের প্রথম পিতা
মাতাকে যেভাবে বেহেশত থেকে বহিষ্কার করেছিল এবং তাদেরকে তাদের গোপনাঙ্গ উভয়ের
সামনে দেখানোর জন্য বিবস্ত্র করেছিল, তোমাদেরকে শয়তান যেন সেভাবে প্রলুব্ধ করতে না
পারে” (আল আরাফ, ২৭)।
পুরুষ ও নারী অবশ্যই শালীনতাপূর্ণ পোষাক পরিধান
করবে। রাসুল (সাঃ)এর সুন্নাহ হচ্ছে যে, মানুষ তার দেহ যথাযথভাবে আচ্ছাদন করবে।
পুরুষদের নাভি থেকে হাটু পর্যন্ত ঢেকে রাখতে হবে। এছাড়া অন্যান্য অংশ বিভিন্ন
কারনে খোলা রাখা যেতে পারে। নারীগণ অবশ্যই তার শরীর যথাযথভাবে ঢেকে রাখবে। নবী
করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন যে, একটি বয়স্ক মেয়ের জন্য তার শরীর খোলা রাখা ঠিক নয়। সে
অবশ্য তার মুখমন্ডল ও হাতের সামনের অংশ খোলা রাখতে পারে (আবু দাঊদ)। নবী করীম
(সাঃ) আরও বলেছেন যে, মহিলাদের এমন পাতলা পোষাক পরতে অনুমতি দেওয়া হয়নি যা তার দেহ
দেখাতে পারে (মুসলিম)।
মহান আল্লাহতায়ালা স্ত্রীলোকদের ওড়না পরার
নির্দেশ দিয়ে ঘোষনা করেছেন, “মুসলীম নারীদেরকে বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত
করে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশ পায় তা ব্যতীত
তাদের সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার ওড়না
দিয়ে আবৃত করে” (আন নূর, ৩১)।
উপরোল্লিখিত বিধান ঘরে বাইরে সমানভাবে
প্রযোজ্য। এ আয়াতে পুরুষদেরকেও তাদের দৃষ্টি সংযত রাখার ও তাদের লজ্জাস্থানের
হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে নারীরা মাথার উপর
একপ্রকারের চাদর দ্বারা পেছনের খোপা বেঁধে রাখত। সম্মুখের দিকের বোতাম খোলা থাকত।
এতে গলা ও বুকের উপরাংশ স্পষ্ট দেখা যেত। বুকের উপর কোর্তা ছাড়া আর কিছু থাকত না।
(ইবনে কাসীর, কাশশাফ, মুহাম্মাদ আসাদ লিখিত ‘মেসেজ অব দি কোর’আন’, সুরা নূরের
তাফসীর অংশ)
এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর মুসলিম মহিলা ও
যুবতীদের মধ্যে ওড়না ব্যবহার করার রেওয়াজ চালু হয়। মুমিন নারীগণ এ নির্দেশ শুনে
দ্রুত সেই অনুযায়ী আমল শুরু করেন।
ইসলাম নারীদের সম্ভ্রমের প্রতি মর্যাদা দেয়।
তাই ইসলাম নারীদের তার সাধারণ পোষাকের উপর চাদর বা ওড়না ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে,
যখন সে কাজের জন্য অন্যান্য উদ্দেশ্যে বাইরে যায়। পবিত্র কালামপাকে এসম্পর্কে
ঘোষণা হয়েছে,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل
لِّأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن
جَلَابِيبِهِنَّ ۚ
ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ ۗ
وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا
“হে নবী! আপনার পত্নী, কণ্যা ও মুমিনদের
স্ত্রীগণকে চাদর (মাথা ও বুক ঢেকে) পরিধান করতে বলুন, এটাই সম্ভ্রান্ত
স্ত্রীলোকদের পরিচয়ের উত্তম পথ এবং এতে করে তাদের উত্যক্ত করা হবে না” (আল আহযাব,
৫৯)।
পোষাকের ফ্যাশনের নামে কোর’আনের বিধান
অমান্য করে আজ ওড়না উঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা অনেকে করছেন। অনেক বয়স্ক মেয়েকে ওড়না ছাড়া
বাইরে চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। টেলিভিশনের অনেক অনুষ্ঠানাদিতেও ওড়না ছাড়া
মেয়েদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে ও অংশগ্রহণ করতে দেয়া হচ্ছে। অথচ
ওড়না ব্যবহারে ইসলামী শালীনতার সর্বোত্তম উদাহরণ। মুসলিম জনগণের দায়িত্ব হচ্ছে
এসংক্রান্ত কোর’আনের নির্দেশ কার্যকর করা।
এছাড়া পোষাক প্রস্তুতকারকদের কর্তব্য
উপযুক্ত ওড়না ও সেলোয়ারসহ পোষাক ডিজাইন করা এবং এমন পোষাক ডিজাইন না করা যার
মাধ্যমে সমাজে ইসলামী শিক্ষার বিরোধী বেহায়াপনা ছড়িয়ে পড়ে। ইসলাম পুরুষ ও নারীর
একই ধরণের পোষাক পরিধান করতে অনুমতি দেয়নি। পুরুষ ও নারীর মধ্যেকার প্রভেদ রক্ষা
করতে চায় ইসলাম। পুরুষ ও নারীর একে অপরের পোষাক পরিধানের মধ্যে কোন বাহাদুরি নাই।
রাসুলে আকরাম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, “পুরুষের
স্ত্রীলোকের মত পোষাক পরিধান করা নিষিদ্ধ এবং স্ত্রীলোকের পুরুষের মত পোষাক পরিধান
করা নিষিদ্ধ” (কিতাবুল লেবাস, সহিহ আল বুখারী)।
হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) নারীদের স্বর্ণালঙ্কার
ও সিল্কের বস্ত্র পরিধান করার অনুমতি দিয়েছেন। তিনি এগুলি পুরুষদের পরিধান করার
অনুমতি দেননি। এর কারণ সম্ভবত এগুলো নারীদের জন্যই প্রকৃতিগতভাবে উপযুক্ত এবং
পুরুষদের জন্য খুব একটা উপযুক্ত নয়। তবে পুরুষরা রুপার আংটি ব্যবহার করতে পারে।
কেননা রাসুল (সাঃ) নিজেই রুপার আংটি ব্যবহার করতেন।
পোষাক ব্যবহারে জাঁকজমক ও আড়ম্বর নিষিদ্ধ
করেছে ইসলাম। মহাগ্রন্থ আল কোর’আনে বলা হয়েছে, “আল্লাহ জাঁকজমকপূর্ণ (গর্বিত)
লোককে পছন্দ করেন না” (সুরা হাদীদ, ২৩)।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি জাঁকজমক বা
গর্ব দেখানোর জন্য তার পোষাক জমি পর্যন্ত স্পর্শ করায় (বিনা কারণে লম্বা করে)
আল্লাহ শেষ বিচারের দিনে তার দিকে তাকাবেন না” (কিতাবুল লিবাস, সহিহ আল বুখারী)।
পোষাক পরিচ্ছদ অবশ্যই পরিষ্কার হতে হবে।
কারণ, ইসলাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার উপর জোর দিয়েছে। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “পরিষ্কার
পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ” (কিতাবুত তাহারাত, সহিহ আল বুখারী)।