তাবলীগীদের অনুসরণীয় ও পঠিত বই ‘ফাজায়েল আমল’ –এর যিকির অধ্যায়ে নিচের ঘটনাতি উল্লেখ আছে যা আমি সংক্ষেপে উল্লেখ করলাম।
“শায়খ আবু করতবী (র;) বলেন, আমি শুনিয়াছি যে
ব্যক্তি সত্তুর হাজার বার কলেমা পড়িবে সে দোযখ হইতে নাজাত পাইবে। ইহা শুনিয়া আমি
নিজের ও আমার স্ত্রীর জন্য সত্তুর হাজারবার এবং অতিরিক্ত কয়েক নিছাব আদায় করিয়া
পরকালের ধন সংগ্রহ করি। আমাদের নিকট এক যুবক থাকিতো এবং সে নাকি কাশফের মাধ্যমে
বেহেশত ও দোযখ দেখিতে পাইতো, আমি উহাতে সন্দেহ করিতাম। একদিন ঐ যুবক আমার সহিত
আহার করিতে বসে চিৎকার করে বলিয়া উঠিলো, আমার মা দোযখে জ্বলিতেছে, আমি তাহার
অবস্থা দেখিতে পাইতেছি। একথা শুনিয়া আমি মনে মনে আমার পড়া কলেমা অতিরিক্ত নিছাব
হতে এক নিছাব (৭০ হাজার) ঐ যুবকের মায়ের নামে বখশিয়া দিলাম, যা আমি ও আল্লাহ ছাড়া
আর কেহ জানতো না। কিছুক্ষণ পর ঐ যুবক বলিয়া উঠিলো, চাচা আমার মা দোযখ থেকে নাজাত
পাইয়া গেলেন। (ফাজায়েল যিকির ১১৫ পৃষ্ঠা/ কোনো সংস্করণে ফাজায়েল আমল ৩৫৪ পৃষ্ঠা)
উক্ত গল্প থেকে একটি নতুন জাল হাদিস তৈরি
হলো যা হলো জান্নাতের ‘সার্টিফিকেট’ নিতে গেলে ‘সত্তুর হাজার বার কলেমা “লা ইলাহা
ইল্লাল্লাহ” পড়লেই যথেষ্ট। অথবা, ‘সত্তুর হাজার বার কলেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”
পাঠ করে এর সওয়াব মৃত ব্যক্তির নামে উতসর্গ করলে সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে।
(নাউযুবিল্লাহ)
এই বিষয় থেকে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণিয়ঃ
১। জান্নাত ও জাহান্নাম ও মৃতব্যক্তির কি
হচ্ছে তা আল্লাহ গায়েব বা অদৃশ্য রেখেছেন। ফাজায়েলে আমল কিতাবে যা উল্লেখ আছে তা
প্রমাণ করে ঐ যুবক গায়েবের খবর জানতো। অথচ গায়েবের খবর একমাত্র আল্লাহ জানেন।
আল্লাহপাক বলেন,
عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ
عَلَىٰ غَيْبِهِ أَحَدًا
“তিনিই (আল্লাহ) গায়েবের অধিকারী, আর তিনি
তার গায়েবের খবর কারও কাছে প্রকাশ করেননা। তবে তার মনোনীত রাসুল ছাড়া” (সুরা
জ্বীন, ২৬)।
রাসুলও (সাঃ) গায়েবের খবর জানতেন না।
আল্লাহপাক কোর’আনে বলেন,
قُل لَّا أَمْلِكُ لِنَفْسِي
نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ ۚ
وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ
السُّوءُ ۚ
إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
“বলুন! আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং
অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ চান। আর আমি যদি গায়েবের কথা জেনে নিতে
পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম, ফলে আমার কোনো অমঙ্গল কখনো হতে
পারতো না। আমি তো শুধুমাত্র একজন ভীতি প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা ঈমানদারদের জন্য”
(আল আরাফ, ১৮৮)।
আল্লাহপাক আরো বলেন,
قُل لَّا يَعْلَمُ مَن فِي
السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ ۚ
وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ
“বলুন! আল্লাহ ব্যতীত নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে
কেউ গায়েবের খবর জানেনা এবং তারা জানেনা যে, তারা কখন পুনরোজ্জীবিত হবে” (সুরা
নামল, ৬৫)।
উক্ত কেচ্ছাকাহিনীটিকে খন্ডন করতে আশাকরি
উপরোক্ত আয়াতদুটিই যথেষ্ট।
২। শায়খ আবু করতবী (রঃ) ব্যক্তিটা কে? তিনি
বলেন, ‘আমি শুনিয়াছি যে.....’। তিনি কোথা থেকে শুনিয়াছেন? কোন হাদিসে এমন কথা আছে?
৩। জনৈক আবু করতবী (রঃ) এটাকে কাশফ বলেছেন।
অদৃশ্য জগতের কিছু কথা প্রকাশ হওয়াকে কাশফ বলে। কাশফ সত্য, মিথ্যা দুটোই হতে পারে।
তাই শরীয়তের ক্ষেত্রে কাশফ একদম গ্রহণযোগ্য নয়। ভন্ডনবী ইবনুস সাঈয়েদ বা গোলাম
আহমেদ কাদিয়ানীও বিভিন্ন মিথ্যা কাশফের দাবী ও ঘটনা বর্ণনা করতো।
৪। যদি এমন সহজেই জাহান্নাম থেকে মুক্তি
পাওয়া যায়, তাহলে জাহান্নামে আর কেউ যেতো না। এগুলো বানিয়ে আসলে মুসলমানদের শুধু
যিকিরনির্ভর সুফীবাদের দিকে নিয়ে যাওয়ার টার্গেট নেওয়া হয়েছে।
তাদের বহু জাল হাদিসের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ
করলামঃ
ক) এক ঘন্টা কিছু সময় চিন্তা যিকির করা, ষাট
বছর ইবাদতের চেয়ে উত্তম। (ফাজায়েল যিকির, ৩০৪ পৃষ্ঠা)
খ) এক ওয়াক্ত নামাজ কাযা হলে ৮০ হুকবা
জাহান্নামে পুড়তে হবে। (ফাজায়েল নামাজ, ৮৯ পৃষ্ঠা)
গ) পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে, বিভিন্নরকম
পুরষ্কার, না পলে বিভিন্নরকম শাস্তি সংক্রান্ত হাদিসটি। (ফাজায়েল নামাজ, ৮০-৮১
পৃষ্ঠা) ইত্যাদি।
এ সমস্ত হাদিসগুলোর সূত্র কোথায়? কে এরকম
বলেছেন? তার সনদ কী? সিয়াহ সিত্তাসহ যতো হাদিস আছে তাতে কোথাও এমন বর্ননা নেই। এ
বিষয়ে বড়ো বড়ো হাদিস বিশারদগণসহ ইসলামিক গবেষকগণও হতভম্ব হয়ে গেছে। তারা এসব
হাদিসের অস্তিত্বও খুঁজে পান নাই।
এছাড়াও আরও অসংখ্য জাল হাদিস ও বিভিন্ন
কেচ্ছাকাহিনী আছে যা পরে পর্যালোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো
ফাজায়েল আমল বইটিতে জাল ও দুর্বল হাদিসগুলোকে চেপে রাখার জন্য কোনো হাদিসের পূর্ণ
উৎস দেওয়া হয়নি। ফাজায়েল আমল পড়লে অনেক আমল নাহয় শেখা যায় কিন্তু সাথে সাথে শিরকও
যদি করি, বিদ’আতও করি বা আকিদাহ নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সেই আমলের কোনো মূল্য নেই
আল্লাহর কাছে। সত্য ও সঠিক অল্প আমলই যথেষ্ট। তাই আল্লাহ বলেন,
أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ
الْخَالِصُ
“আল্লাহর নিকট এখলাসপূর্ণ শিরকমুক্ত ইবাদতই
গ্রহণযোগ্য” (সুরা যুমার, ৩)।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এজন্যই হয়তো বলেছিলেন,
“আমি আমার উম্মতের জন্য বিপথগামীকারী ইমাম ও নেতৃবর্গের আশংকা করছি” (সহিহ
তিরমিজী)।