নফল নামাজ পড়ায় ও যিকিরে প্রচুর সওয়াব আছে। তবে কম পড়লে বা না পড়লেও তেমন গুনাহ নেই। বেশি বেশি সওয়াবের কাজে তো তখনোই কল্যাণ যখন গুনাহর কাজ থেকে বাঁচার একটি ব্যবস্থা হয়। গুনাহর কাজ থেকে বাঁচার রাস্তা হলো ফরজ আদায় এবং গুরুত্বপূর্ণ ফরজ হলো সমাজ ও রাষ্ট্রে আল্লাহর খলিফারূপে দায়িত্বপালন। সেটি এক্বামতে দ্বিনের দায়িত্ব। একাজের মধ্য দিয়েই সমগ্র বিশ্ববাসীর উপর মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব। এক্বামতে দ্বীনের যেকোনো প্রচেষ্টাই হলো আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম। এই সংগ্রাম আন্দোলনে আত্মোনিয়োগের মধ্য দিয়েই ঈমানদারীর আসল পরীক্ষা হয়। ঈমানদারের দাবীতে মানুষ যে প্রচন্ড ভন্ড হতে পারে সে প্রমান তো প্রচুর আছে। সে ভন্ডরা নবীজীর (সাঃ) যুগে যেমন ছিলো আজও তেমন আছে। সে ভন্ডামি ও ঈমানের নামে আত্মপ্রবঞ্চনা দূর করতেই মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোর’আনে প্রকৃত ঈমানদারের সংজ্ঞা ও মান ঠিক করে দিয়েছেন। মুমিনের দায়িত্ব হলো সে সংজ্ঞা ও মানের সাথে নিজের কর্মকে মিলিয়ে দেখা। পবিত্র কোর’আন হলো এক্ষেত্রে মহান আল্লাহর দেয়া মিযান বা দাড়িপাল্লা দিয়ে যেকোনো ব্যক্তি তার ঈমানদারী ও কর্মের ওজন করতে পারে। প্রকৃত ঈমানদারের সংজ্ঞাটি বেঁধে দেয়া হয়েছে এভাবে, আল্লাহপাক বলেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ
الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا
بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۚ
أُولَٰئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ
“একমাত্র তারাই মুমিন যারা আল্লাহ ও তার
রাসুলের উপর ঈমান আনে, এরপর আর সন্দেহ পোষণ করেনা এবং জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর
রাস্তায় জেহাদ করে, তারাই (ঈমানদারীর ব্যাপারে) সত্যবাদী” (সুরা হুজরাত, ১৫)।
উপরোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে, শুধু আল্লাহ ও তার
রাসুলের (সাঃ) উপর অটল বিশ্বাসকে মুমিন হওয়ার জন্য যথেষ্ঠ নয়। বরং শর্ত আরোপ করা
হয়েছে, যে সে বিশ্বাসে কোনোরূপ সংশয় রাখা যাবেনা এবং বিশ্বাসের সাথে অবশ্যই জান ও
মালের দ্বারা সংগ্রাম আন্দোলনও করতে হবে। নবিজীর (সাঃ) হাদিসে ইসলামের যে পাঁচটি খুটির
কথা বলা হয়েছে সে খুঁটিগুলোর মাঝে কলেমা, নামাজ, রোজা, যাকাত ও হজ্জ আছে কিন্তু
সংগ্রাম আন্দোলনের কথা নেই। কিন্তু উপরের আয়াতে প্রকৃত মুমিন হওয়ার জন্য ঈমানের
সাথে সংগ্রাম আন্দোলনের কথা সংমিশ্রন ঘটানো হয়েছে। এভাবে পাঁচটি খুটির মাঝে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ খুঁটিটিকে ঈমান ও সংগ্রামের সম্মিলিত খুঁটিরূপে খাড়া করা হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোর’আনে বলেন,
وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ
يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ
الْمُنكَرِ ۚ
وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“তোমাদের মধ্যে অবশ্যই একটি দল থাকবে যারা
মানুষকে ভালো কাজে ডাকবে এবং ন্যায় কাজের নির্দেশ দিবে এবং খারাপ কাজ থেকে রুখবে।
(প্রকৃতপক্ষে) তারাই তো সফলকাম” (আল ইমরান, ১০৪)।
তাই মুসলমানদের কাজ মানুষকে শুধু নামাজে
ডাকা নয় বরং নামাজের সাথে সকল প্রকার ভালো কাজে ডাকা এবং মানুষকে সৎকাজে নির্দেশ
দেওয়া এবং খারাপ কাজের জন্য রুখে দাড়া। আল্লাহর দরবারে সফলকাম হওয়ার জন্য এগুলোকে
অপরিহার্য বলা হয়েছে। কিন্তু যেখানে মানুষকে নির্দেশ দেয়া এবং তাদেরকে কোনো কর্ম থেকে রুখবার প্রশ্ন
এসে যায় সেখানে শক্তির প্রয়োজনীয়তাও দেখা দেয়। স্বৈরাচারী দুর্বৃত্তগণ তাদের অধিকৃত দেশে কোনো সৎকাজে আদেশ বা অন্যায় কাজে
রুখবার নির্দেশ দেয়ার অধিকার দেয়া তো দূরে থাক, সত্য প্রচারের সুযোগটুকু দিতেও
রাজী নয়। নবীজী (সাঃ) তার তেরো বছরের মক্কার জীবনে কি সে সুযোগ পেয়েছিলেন? ন্যায়
কাজে আদেশ এবং অন্যায় কাজ থেকে রুখবার সুযোগও পাননি। কারণ, সে জন্য তার হাতে
রাজনৈতিক শক্তি ছিলো না। কিন্তু সেগুলি তিনি মদীনায় গিয়ে করতে পেরেছিলেন। কারণ
সেখানে তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান। একই কাজ তার থে প্রাপ্ত অথরিটির বলে সাহাবাগণও
করতেন। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন,
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ
أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ
وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ
“তোমরাই হলে সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ উম্মত;
তোমাদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য; তোমরা ন্যায় কাজের
আদেশ দিবে, অন্যায় কাজের নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে” (আল ইমরান,
১১০)।
উপরোক্ত আয়াতে সকল মানুষের মাঝে মুসলমানদের
আল্লাহতায়ালা শ্রেষ্ঠ মানুষরূপে চিত্রিত করেছেন। সেটি তাদের বর্ণ, ভাষা বা ভৌগলিক
কারণে নয়। বরং তাদের জীবনের মিশন ভিশন, লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও কর্মের কারণে। আর সেটি
হলো, তারা বাঁচবে শুধু নিজেদের কল্যাণে নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর কল্যাণে। বিশ্ববাসীর
কল্যাণের মাঝেই তাদের নিজেদের কল্যাণ। তাদেরকে তারা ন্যায় কাজের আদেশ দিবে ও
অন্যায় কাজ থেকে রুখবে এবং আল্লাহকে বিশ্বাস করবে। অমুসলমানদেরকে দাওয়াতের গন্ডির
বাইরে রাখাটি তাই ঈমানদারী নয় বরং সেটি হলে তা হবে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। নবীজী (সাঃ) আজীবন কাফেরদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন এবং
এভাবে উপরোক্ত আয়াতে ঘোষিত হুকুমের প্রয়োগ করে গেছেন। কিন্তু সেটি উপেক্ষিত হচ্ছে
তাবলীগী জামা’আতের কাছে। উপেক্ষা করছে অধিকাংশ মুসলমানরাও।