ক) আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর অসীলাহ
খ) নেক আমলের অসিলাহ
গ) নেক ব্যক্তির দোয়ার অসীলাহ
আপনাদের সামনে প্রকারগুলো দলীলসহ বিস্তারিত
বর্ণনা করা হলো-
ক) আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর অসীলাহঃ আল্লাহর
নাম ও গুণাবলীর অসীলাহ গ্রহণ করার নিয়ম, যেমন মুসলিম ব্যক্তি তার দোয়ায় বলবে, ‘হে
আল্লাহ! তুমি প্রজ্ঞাময় পরাক্রমশালী করুণাময় কৃপানিধান। হে আল্লাহ তাই তোমারই
অসীলায় তোমার রহমতের অসীলায় তোমার নিকট আমার জন্য রহমত ও ক্ষমা ভিক্ষা চাইছি। অথবা
আনুরূপ আল্লাহর সুন্দরত্ম নাম ও গুণাবলীর মাধ্যম ধরে দোয়া করবে’ আল্লাহর কিতাব ও
হাদিসে এ প্রকার অসীলাহর প্রতি নির্দেশ দান করা হয়েছে।
আল্লাহ বলেন,
وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ
الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا ۖ وَذَرُوا الَّذِينَ
يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ ۚ سَيُجْزَوْنَ مَا
كَانُوا يَعْمَلُونَ
“আর আল্লাহর অনেক সুন্দরতম নাম রয়েছে। অতএব
সেগুলোর অসিলায় তাকে আহ্বান করো এবং পরিত্যাগ করো ওদেরকে যারা তার নামসমূহের ভিতর
বিকৃতি সাধন করে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল শিঘ্রই পাবে” (সুরা আরাফ, ১৮০)।
খ) নেক আমলের অসীলাহঃ নেক আমল বা সৎ আমল যার
ভিতর কবুল হওয়ার নির্ধারিত শর্ত পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। আল্লাহর নিকট সৎ আমলের
দ্বারা অসিলাহ গ্রহণ করা আর তা এরূপ যেমন, দোয়াআকারী বলবে, “হে আল্লাহ! তোমার
প্রতি আমার ঈমান, তোমার জন্য আমার ভালোবাসা এবং তোমার রাসুলের অনুসরণ ও অনুকরণের
অসীলায় আমাকে ক্ষমা করে দাও।” আর এরূপ শরীয়তসম্মত দোয়ার অসীলাহ গ্রহণ করা যায়। এ
সকল অসীলাহ নির্দেশনায় আল কোর’আন থেকে আল্লাহতায়ালার কিছু বাণী উদ্ধৃত করা হলো,
الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا
إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
“হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চিতরুপে আমরা
ঈমান এনেছি অতএব আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দাও এবং দোযখের শাস্তি থেকে রক্ষা
করো” (আল ইমরান, ১৬)।
আল্লাহপাকের বাণী,
رَبَّنَا آمَنَّا بِمَا أَنزَلْتَ
وَاتَّبَعْنَا الرَّسُولَ فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِينَ
“হে আমাদের প্রতিপালক তুমি যা অবতীর্ণ করেছো
আমরা তার উপর ঈমান এনেছি এবং তোমার রাসুলের অনুসরণ করেছি অতএব আমাদেরকে
সাক্ষ্যপ্রদানকারীদের (মোহাম্মদী উম্মতের সৎকর্মশীল বান্দাদের) দলে লিপিবদ্ধ করো”
(আল ইমরান, ৫৩)।
আল্লাহর আরও বাণী,
رَّبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا
مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا ۚ
رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا
مَعَ الْأَبْرَارِ
“হে আমাদের রব! আমরা শ্রবণ করেছি ‘তোমাদের
প্রতিপালকের উপর ঈমান আনো বলে’ ঘোষণা প্রদানকারীর ঘোষণা অতঃপর আমরা ঈমান এনেছি,
অতএব আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করো এবং আমাদের পাপরাশি মোচন করো এবং সৎ ব্যক্তিদের
সাথে মৃত্যু দান করো” (আল ইমরান, ১৯৩)।
হাদিসে থেকে দলীল হিসেবে বুরাইদা (রাঃ)-এর
হাদিস প্রনিধানযোগ্য। বুরাইদা (রাঃ) বলেন, “নবী (সাঃ) এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলেন,
‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট এই অসীলায় চাচ্ছি যে, আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি তুমি
সেই আল্লাহ যিনি ব্যতীত আর কেউ প্রকৃত উপাস্য নেই। তুমি একক, মুখাপেক্ষীহীন, যিনি
কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি এবং তার সমকক্ষ কেউ নেই’। এতদশ্রবণে নবী
(সাঃ) বললেন, এ ব্যক্তি আল্লাহর নিকট তার এমন সুমহান নামের অসীলায় আবেদন করেছে যে,
তার মাধ্যমে আবেদন করা হলে, প্রদান করেন এবং প্রার্থনা করা হলে, কবুল করেন”
(তিরমিজী, ইবনে মাজাহ)।
আর এ বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করে তিন ব্যক্তির
ধটনা সম্বলিত আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ)-এর হাদিস। তারা এক গর্তে প্রবেশ করে আশ্রয়
নিলে একতি পাথর উপর থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে দেয়। এমতাবস্থায় তারা
একে অপরকে বললো, ‘তোমরা তোমাদের সৎ আমল সমূহের অসীলায় আল্লাহর নিকট দোয়া করো’।
অতঃপর তাদের একজন পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারের দ্বারা অসীলাহ গ্রহণ করলো। দ্বিতীয় ব্যক্তি
আল্লাহর ভয়ে অবাধ্যতার কাজ থেকে বিরত হওয়ার অসীলাহ গ্রহণ করলো। তার চাচাতো বোনকে
আয়ত্তে পাওয়ার পর যখন সে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দেয় তখন সে আল্লাহর ভয়ে তাকে ছেড়ে
দেয়। তৃতীয় ব্যক্তি তার আমানতদারীতা ও
সততার অসীলাহ গ্রহণ করলো। আর তা এভাবে, এক শ্রমিক তার পারিশ্রমিক চেড়ে চলে গেলে সে
তার পারিশ্রমিক সম্পদকে বিপূল সম্পদে পরিণত করে। পরবর্তীকালে সে এসে তার সম্পদ
নিয়ে যায় কিছুই ছেড়ে যায়নি। (বুখারি, মুসলিম)। [এখানে ঘটনার সারাংশ উল্লেখ করা হয়েছে] এই
ঘটনাটি মুসলিম ব্যক্তির খুলুসিয়াতপূর্ণ আমলের অসীলাহগ্রহন শরীয়তসম্মত হওয়ার প্রতি
নির্দেশ করে।
গ) নেক ব্যক্তির দোয়ার অসীলাহঃ আল্লাহর নিকট
সৎ ব্যক্তির দোয়ার অসীলাহ গ্রহণ যেমন কোনো মুসলিম ব্যক্তি চরম সংকটে পড়লে বা তার
উপর কোনো বিপদ আপতিত হলে এবং নিজেকে আল্লাহর হক আদায়ে ত্রুটি সম্পন্ন মনে করলে সে
আল্লাহর নিকট নেক ব্যক্তির অসিলায় দোয়া করতে পারে। এজন্য এমন এক ব্যক্তির নিকট
যেতে হবে যাকে পরহেযগারী, পরিশুদ্ধি, ও মর্যাদাবান এবং কোর’আন হাদিস বিদ্যায় অধিক
উপযুক্ত মনে হবে। তার নিকট বিপদমুক্তির ও দুশ্চিন্তা দুরীকরণের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া
করার আবেদন করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে সুন্নাহ ও সাহাবাগণের আচরণ নির্দেশ করে।
সুন্নাহ থেকে দলীলঃ আনাস (রাঃ)-এর বর্ণিত
হাদিস “এক পল্লীবাসী বেদুইন নবী (সাঃ)-এর মিম্বরে খুৎবাহ দানকালে মসজিদে প্রবেশ
করে বললো, হে আল্লাহর রাসুল আমাদের সম্পদ নষ্ট হয়ে গেল, রাস্তাঘাট বিচ্ছিন্ন হয়ে
গেলো অতএব আপনি আল্লাহর নিকট দোয়া করুন যেন তিনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করেন। নবী
(সাঃ) দু’খানা হাত উঠিয়ে দোয়া করলেন, এ পরিমাণ হাত উঠিয়েছিলেন যে, আমি তার বগলের
শুভ্রতা পর্যন্ত দেখেছিলাম। (দোয়াটি এই) “হে আল্লাহ! আমাদেরকে বৃষ্টি দান করো, “হে
আল্লাহ! আমাদেরকে বৃষ্টি দান করো, “হে আল্লাহ! আমাদেরকে বৃষ্টি দান করো। লোকেরাও
তাদের হাত উঠিয়ে দোয়া করলো। আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম করে বলছি, (দোয়ার পূর্বে) আমরা আসমানে
ব্যপক অংশ জুড়ে মেঘের একটিও খন্ড দেখি নাই, আমাদের মাঝে ও সিলা’র মাঝে কোনো
ঘরবাড়িও ছিলো না। দোয়ার পর রাসুল (সাঃ) –এর পিছন দিক থেকে মেঘ প্রকাশিত হলো ঢালের
ন্যায়। আসমানের মাঝামাঝি স্থানে এসে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো এবং বর্ষিত হলো। সেই
সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন নবী (সাঃ) হাত রাখেননি যে পর্যন্ত মেঘমালা পাহাড়সম
আঁকারে বিস্তৃতি লাভ করেছিলো। অতঃপর মিম্বর থেকে অবতরণ করার পূর্বেই দেখতে পেলাম
তার দাড়ির উপর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। অতঃপর তিনি সালাত আদায় করলেন, আমরা সালাত
শেষে বের হলাম এবং ভিজতে ভিজতে বারিতে পৌছলাম। দ্বিতীয় জুম’আহ পর্যন্ত এ বৃষ্টি
অব্যাহত থাকে। অতঃপর ঐ পল্লীবাসী বেদুইন লোকটি বা অন্য কেউ এসে বললো, ‘হে আল্লাহর
রাসুল! আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করুন, যেন তিনি আমাদের থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেন। নবী
(সাঃ) মৃদু হাসলেন এবং তার হাত দু’খানা তুলে বললেন, (দোয়াটি এই) “হে আল্লাহ!
আমাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বৃষ্টি দাও, আমাদের উপর নয়। হে আল্লাহ! ঢিলার উপর, ছোট
ছোট পাহাড়ের উপর, মাঠের ভিতর ও গাছপালা উৎপাদন স্থানগুলোতে।” তারপর মেঘ সরে গেলো
এবং মদীনার পার্শ্বস্ত ভূমিগুলোতে বর্ষণ হতে লাগলো। মদীনায় আর একটুও বৃষ্টি বর্ষিত
হলো না।’ (বুখারী, মুসলিম)।
সাহাবাগণের আমল হতে প্রমাণঃ এ মর্মের
হাদিসটিও আনাস (রা;) থেকে বর্ণিত, “লোকেরা যখন অনাবৃষ্টিতে ভূগতো তখন উমার (রা;)
আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ)-এর মাধ্যমে বৃষ্টি চাইতেন। তিনি বলতেন, “হে
আল্লাহ! আমরা তোমার নিকট আমাদের নবীর অসীলাহ ধারণ করলে তুমি আমাদেরকে বৃষ্টি দিয়ে
থাকতে, আর এখন আমরা তোমার নিকট আমাদের নবীর চাঁচার অসীলাহ ধারণ করছি। অতএব
আমাদেরকে বৃষ্টি দান করো”। বর্ণনাকারী বলেন, ফলে তারা
বৃষ্টি প্রাপ্ত হতো। (বুখারী)
উমার (রা;)-এর বাণী ‘আমরা তোমার নিকট আমাদের
নবীর অসীলাহ ধারণ করতাম আর এখন আমরা তোমার নিকট আমাদের নবীর চাঁচার অসীলাহ ধারণ
করছি’ – এর অর্থ, আমরা আমাদের নবীর স্মরণাপন্ন হতাম এবং তার নিকট আল্লাহর কাছে
দোয়ার আবেদন করতাম এবং তার দোয়ার অসীলায় আল্লাহর নৈকট্য কামনা করতাম। আর এখন
যেহেতু তিনি উর্দ্ধতন বন্ধুর সান্নিধ্যে চলে গেছেন (ইন্তেকাল করেছেন) সেহেতু
আমাদের জন্য তার পক্ষে দোয়া করা সম্ভব নয় তাই আমরা নবীর চাঁচার সম্মুখীন হচ্ছি এবং
আমাদের জন্য দোয়ার আবেদন করছি। এসব কথার অর্থ এটা নয় যে, তারা তাদের দোয়ায় এরূপ
বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আব্বাস (রাঃ)-এর মান মর্যাদার অসিলায় আমাদের বৃষ্টি দান করো।’
কারণ এ ধরণের দোয়া বিদ’আতী। কোর’আন ও হাদিসে এর কোনো ভিত্তি নেই। এরূপ অসীলাহ
পূর্বসূরী কোনো বিদ্বান ধারণ করেননি।
অনুরূপভাবে মুয়াবিয়া (রাঃ) তার যুগে ইয়াযিদ
বিন আসয়াদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অসীলাহতে অর্থাৎ তার দোয়ার অসীলাহতে বৃষ্টি
চেয়েছিলেন। তিনি (ইয়াযিদ) সম্মানিত তাবেঈগণের একজন ছিলেন।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, যদি
ব্যক্তিসত্তা, সম্মান ও মর্যাদার অসীলাহ ধারণ করা শরীয়তসম্মত হতো তাহলে উমার ও
মুয়াবিয়া (রাঃ) আল্লাহর রাসুল (সাঃ)-এর অসীলাহতে পানি চাওয়া বাদ দিয়ে আব্বাস (রাঃ)
ও ইয়াযিদ বিন আসয়াদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অসীলাহ ধারণ করার শরণাপন্ন হতেন না। কাজেই
আমরা বিদ’আতীভাবে কখনোই দোয়ার অসীলাহ করবো না।