এপ্রসঙ্গে একটি কথা হল, আল্লাহর দাঈ হতে গেলে তাকে ইলম শিক্ষায় পারদর্শী হতে হবে, তাকে আলেম হতে হবে। কেননা আলেমগণ হলেন বান্দাদের জন্য আল্লাহর বিশেষ রক্ষী। কারণ তারা শরীয়তকে ভ্রান্তপন্থীদের বিকৃতি ও অজ্ঞদের অপব্যাখা থেকে রক্ষা করেন। আলেমদের জন্য এ এক বিশাল মর্যাদার ব্যাপার। দ্বীনের ব্যাপারে তাদের কাছেই ছুটে যেতে হয়। হতে হয় তাদেরই স্মরণাপন্ন। কেননা আল্লাহপাক অজ্ঞদের জন্য আবশ্যক করে দিয়েছে তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে। তিনি ইরশাদ করেন,
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن
كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
“অতএব জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো, যদি তোমাদের
জানা না থাকে” (আন নাহল, ৪৩)।
আর প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানীরা মানুষের জন্য
চিকিৎসক। কেননা দেহের রোগের চেয়ে তাদের আত্মার রোগই বেশি। কারণ, মূর্খতা একটি রোগ
আর এই রোগগুলোর ওষুধ হল এই ইলম। যেমন রাসুল (সাঃ) বলেন, “নিশ্চয় অজ্ঞতার চিকিৎসা
হল জিজ্ঞাসা” (আবু দাঊদ, ৩৩৬)।
হজরত মুয়াবিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর
রাসুল (সাঃ) বলেন, “আল্লাহ যার জন্য কল্যাণ চান তাকে দ্বীনি জ্ঞান দান করে থাকেন”
(বুখারী, ৭১; মুসলিম, ১০৭৩; ইবনে মাজাহ)।
এখন প্রশ্ন হলো জ্ঞানী ব্যক্তি বা আলেম
কারা?
কোর’আন ও হাদিসের আলোকে জ্ঞানী ব্যক্তি বা আলেম
হলো ঐ ব্যক্তি যার ইলম (ইসলামিক জ্ঞান বা শিক্ষা/এলেম) আছে এবং তদানুযায়ী আমল করে।
“হজরত ওমর (রাঃ) একদিন হজরত কা’আব (রাঃ)-কে
জিজ্ঞেস করলেনঃ প্রকৃত আলেম কারা? তিনি জবাবে বললেন, যারা ইলম অনুযায়ী আমল করে
তারাই। ওমর (রাঃ) পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, কোন জিনিস আলেম ওলামাদের ক্কলব হতে এলেমকে
বের করে দেয়? (অর্থাৎ এলেমের নূর, ফল, তাছির ও বরকত বের করে দেয়)। জবাবে তিনি
বললেন, দুনিয়ার লোভ, সম্পদের লোভ, সম্মানের লোভ ইত্যাদি” (দারেমী, মিশকাত)।
উপরোক্ত হাদিস দ্বারা এটা জানা যায় যে এলেম
প্রকৃতপক্ষে মাথায় থাকেনা, বরং এলেম থাকে ক্কলবের মধ্যে। আমাদের ক্কলবে উপকারী
এলেম প্রবেশ করাতে হবে। এজন্য আগে ক্কলব সংশোধন করা চাই। যদি আপনি আপনার ক্কলব
সংশোধন করাতে চান তাহলে আপনাকে ইলম শিক্ষা অর্জন করতে হবে হক্কানী আলেমের নিকট
থেকে। আপনার আলেম যদি হক্কানী নাহয় তাহলে আপনার দুনিয়া ও আখিরাত দুটোই বরবাদ হয়ে
যাবে।
শিক্ষা প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা নিজেই জবাব
দিয়েছেন,
قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ
يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ۗ
إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ
“বলুন, যারা জানে এবং যারা জানেনা; তারা কি
সমান হতে পারে? চিন্তাভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান”(সুরা যুমার, ৯)
আল্লাহপাক কিছু ব্যক্তিকে গভির জ্ঞান আহরণ
করার কথা বলেছেন,
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ
لِيَنفِرُوا كَافَّةً ۚ
فَلَوْلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوا فِي
الدِّينِ وَلِيُنذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ
يَحْذَرُونَ
“আর সমস্ত মুমিনের অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত
নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটা অংশ কেন বের হয়না, যাতে দ্বীনের গভীর জ্ঞান লাভ
করে এবং সংবাদ দাব করে আপন সম্প্রদায়কে, যখন তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা
(গুনাহ থেকে) বাঁচতে পারে” (সুরা তাওবা, ১২২)
এখন দেখা যাক সাধারণ শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষা
সম্পর্কে বিশ্বের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ইসলামি শিক্ষাবিদ ও সালাফে সালেহীন বা
পূর্বত্ন মনিষীরা কি কি বলেছেনঃ
কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল বলেছেন,
“মানুষের খুশির বা রুহের উন্নয়নই আসল শিক্ষা।” (ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত)
আব্দুর রহমান নিহলাওয়ী বলেন, “শিক্ষা হল
ব্যক্তিক ও সামষ্টিক ব্যবস্থা যা ইসলামকে গ্রহণ এবং তা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীজীবন
প্ররযায়ে প্রয়োগের দিকে নিয়ে যায়। অন্যকথায়, তা হল ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের প্রতিটি
ক্ষেত্রে ইসলামের লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মানুষের চেতনার উন্নয়ন এবং তার
আবেগ ও আচরণকে দ্বীনে ইসলামের ভিত্তির ওপর নির্মাণ করা” (আব্দুর রহমান নিহলাওয়ী,
উসুলুত তারবিয়্যাতিল ইসলামিয়া, পৃষ্ঠা ২৭)।
শায়খ আমীন মোহাম্মদ আঊয বলেন, “শিক্ষা হলো
ইসলামিক ব্যক্তিত্বের চৈন্তিক, শারীরিক ও সামাজিক সকল উন্নয়ন এবং জীবনের প্রতিটি
ক্ষেত্রে ইসলামের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষা অনুযায়ী তার আচরণকে
সুন্দর করা” (শায়খ আমীন মোহাম্মদ আঊয, আসালিবুত তারবিয়া ওয়াত তালীম ফিল ইসলাম,
পৃষ্ঠা ৩৪)।
সক্রেটিসের মতে, “শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মিথায়র
বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার।” (ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত)
এরিস্টটল বলেছেন, “শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য
হলো ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা।”
(ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত)
ডাঃ খুরশীদ আহমেদের মতে, “স্বকীয় সংস্কৃতি ও
আদর্শের ভিত্তিতে সুনাগরীক তৈরি করা।.............................. এবং জাতীর
ধর্ম ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন হওয়াই উচিৎ শিক্ষার উদ্দেশ্য।” (ইন্টারনেট থেকে
প্রাপ্ত)
উপরোক্ত
শিক্ষাবিদদের উক্তিগুলো থেকে এটা পরিষ্কার যে, আমরা যে শিক্ষাই অর্জন করি না কেন,
সবচেয়ে ধর্মীয় শিক্ষাই হবে এর মূল উদ্দেশ্য। এখানে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে ইসলামি
শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কেননা, যার মধ্যে ইসলামি শিক্ষা নেই তার
নামের পেছনে ছয় হাত লম্বা ডিগ্রী থাকলেও (পার্থিব জগতে মূল্য থাকলেও) সেই শিক্ষার
কোনো মূল্য নেই। হ্যাঁ, মুসলিমকে প্রয়োজনীয় আধুনিক শিক্ষাও শিখতে হবে। কোর’আন ও
সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করাও তার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। সুতরাং তার উচিৎ উল্লেখিতভাবে
তারতম্যটাকে মাথায় রেখে এ দুটোর উপরই গুরুত্ব দেওয়া। উদাহরণতঃ যদি কোনো ছাত্র
গণিত, কৃষিবিদ্যা ও রসায়ন অধ্যয়ণে এক ঘন্টা সময় ব্যয় করে তাহলে কোর’আন, হাদিস ও
ফিকাহ অধ্যয়ণে তার ন্যুনতম দুই ঘন্টা ব্যয় করা উচিৎ। এর বিপরীতটা করা সমীচীন হবে
না। অর্থাৎ অগ্রাধীকার দিতে হবে ইসলামি তথা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের কল্যাণদাতা
কোর’আন ও সুন্নাহকেন্দ্রীক জ্ঞানকে। ফরজ ইলম অর্জন করতে হবে সবাইকেই। আর
বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে হবে কতিপয়কে (সবাই হলে আরও ভাল)। অনুরুপ জাগতিক স্বার্থ ও
কল্যাণ সংক্রান্ত জ্ঞানেও কিছু সংখ্যক লোককে প্রাজ্ঞতা ও উতকর্ষতা সাধন করতে হবে।
তবে ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দিয়ে নয়। তারা ফরজ ইলমও অর্জন করে মানুষের খেদমত করে
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়েতে মেধা ও শ্রম দেবেন জাগতিক প্রয়োজন পূরণে, যাবতীয়
জ্ঞান বিজ্ঞান ও গবেষণা আবিষ্কারের পেছেনে, বলার অপেক্ষা রাখেনা তারাও সফলকাম
হবেন। তাই মুসলিমদের সাধারণ শিক্ষার সিলেবাসে অবশ্যই প্রয়োজন পরিমাণ ইসলামি
শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতেই হবে। ইসলামি শিক্ষাশুন্য কোনো ব্যবস্থাই মুসলিমের
গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।