১। সাধারণ অর্থঃ সাধারণ অর্থে শিরক হলো-
কথা, কাজ, বিশ্বাস কিংবা অভ্যাস দ্বারা আল্লাহর সর্বসুন্দর নামসমূহে বা তার সর্বোত্তম
গুণাবলী ও বৈশিষ্টে অন্য কাউকে বা কোনোকিছুকে অংশীদার করা, অথবা যেসব বিষয় এককভাবে
আল্লাহর প্রাপ্য তথা হক তাতে অন্য কাউকে অংশীদার বা যুক্ত করা কিংবা যেসব কর্ম বা
কতৃত্বের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ সেসকল কর্মে অন্য কাউকে বা কোনোকিছুকে শরীক করা।
মোটকথা এমন যেকোনো বিশ্বাস, কাজ, কথা ও
অভ্যাসকে শিরক বলা হয় যাদ্বারা মহান আল্লাহর ‘রুবুবিয়্যাহ (পালনকতৃত্বে)’ বা তার
‘উলুহিয়্যাহ (ইবাদতে)’ কিংবা আল্লাহর ‘আসমা ওয়াসসিফাতে (সর্বসুন্দর নাম ও
গুণাবলীতে)’ অন্য কারো অংশীদারিত্ব বা সমকক্ষতা সাব্যস্ত করা হয়।
২। বিশেষ অর্থঃ ইবাদতে আল্লাহর সাথে কাউকে
সংযুক্ত বা অংশীদার করাকে শিরক বলা হয়। যেকোনো প্রকার ইবাদত আল্লাহ ব্যতীত অন্য
কারো উদ্দেশ্যে নিবেদন করা, যদিও তা খুবই সামান্য পরিমাণে হয়ে থাকে তথাপি তা হবে
শিরক।
পৃথিবীতে পাপ নামক যত প্রকারের কার্যক্রম
রয়েছে তারমধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ও বড় পাপ হচ্ছে শিরক। শিরক সবচেয়ে বড় পাপ হওয়ার মূল
কারণ হলো এটা সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর অস্তিত্ব ও সত্তার প্রতি প্রভাব ফেলে। যা
মহান আল্লাহ বরদাশত করতে পারেন না। এই পৃথীবিতে হজরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে শেষ
নবী হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত যে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী ও রাসুল
এসেছেন, তাদের মৌলিক প্রধান কাজ ছিলো শিরক উৎখাত করে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা। তারা
প্রত্যেকেই আজীবন সর্বশক্তি প্রয়োগ করে শিরকের মূল শিকড় উপড়ে ফেলার জন্য অবিরাম
সংগ্রাম করে গেছেন। সাথে সাথে সমাজের সর্বস্তরে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক
প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাদের তিরোধানের পর এ দায়িত্ব হকপন্থী আলেমদের উপর অর্পণ করে
গেছেন। বড় পরিতাপের বিষয়, আজ আমাদের সমাজের সর্বস্তরে শিরকের জয়জয়কার চলছে। শিরক
যেন একটি মামুলী ব্যাপার। মানুষ একে হালকা জ্ঞান করছে। ফলে অহরহ তারা অগণিত শিরক
করলেও তাদের মাঝে অনুশোচনার কোনো লক্ষণ নেই। আল্লাহপাক শিরক সম্পর্কে কোর’আনে
বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن
يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ ۚ
وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَىٰ إِثْمًا عَظِيمًا
“নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে
লোক তার সাথে শরীক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ, যার জন্য তিনি
ইচ্ছা করেন। আর যে লোক অংশীদার সাব্যস্ত করলো আল্লাহর সাথে, সে যেন অপবাদ আরোপ
করলো” (সুরা নিসা, ৪৮)।
শিরক করলে পূর্বের সমস্ত আমল নষ্ট হয়ে যায়।
আল্লাহপাক বলেন,
ذَٰلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي
بِهِ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ ۚ
وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“এটি আল্লাহর হেদায়েত, স্বীয় বান্দাদের
মধ্যে যাকে ইচ্ছা এ পথে চালান। যদি তারা শিরক করতো, তবে তাদের কাজকর্ম তাদের জন্য
ব্যর্থ হয়ে যেতো” (সুরা আন’আম, ৮৮)।
এবার দেখুন, নবীকেও ছাড় দেওয়া হয় নাই।
আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ
وَإِلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ
وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
“(হে নবী) আপনার প্রতি এবং আপনার
পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে, যদি আল্লাহর শরীক স্থির করেন, তবে আপনার
কর্ম নিষ্ফল হবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবেন” (সুরা যুমার, ৬৫)।
আল্লাহপাক আরো বলেন,
إِنَّهُ مَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ
فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ ۖ
وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ
“নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার
স্থাপন করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হবে
জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোনো সাহায্যকারী নেই” (সুরা মায়িদাহ, ৭২)।
হজরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “তোমরা
এমন সব কাজ কর যা তোমাদের দৃষ্টিতে চুলেও চেয়েও সুক্ষ্ণ। কিন্তু আমরা রাসুলুল্লাহর
যুগে এগুলোকে মনে করতাম ধ্বংসকারী” (বুখারী)।
হজরত ইবনে মাসূদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি
বলেন, “একজন মুমিন গুনাহকে এভাবে দেখে থাকে যে, সে যেন এক পাহাড়ের নিচে বসে আছে যা
তার মাথার উপর ভেঙ্গে পড়বে। পক্ষান্তরে পাপী তার গুনাহকে এভাবে দেখে যেন মাছি তার
নাকের ডগায় বসেছে, তাকে এভাবে তাড়িয়ে দেয়া যাবে” (বুখারী)।
শিরকের উৎপত্তিঃ আদম (আঃ) ও নূহ (আঃ)-এর
মধ্যকার ব্যবধান প্রায় সহস্রাব্দ ছিলো। এসময় মানুষ তাওহীদের প্রতি বিশ্বাসী ছিলো।
সে সময় কোনো শিরক পৃথীবিতে ছিলো না। দুনিয়াতে প্রথম শিরক সংঘটিত হয়েছিলো নূহ
(আঃ)-এর সম্প্রদায়ের মধ্যে। আর তা হয়েছিলো সৎ ও বুজুর্গ লোকদের মাধ্যমে। আল্লাহ
বলেন,
وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ
آلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ
وَنَسْرًا
“তারা বললো তোমরা তোমাদের উপাস্যদের ত্যাগ
করোনা আর তোমরা ওয়াদ, সূয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক এবং নাসরকেও ত্যাগ করো না” (সুরা নূহ,
২৩)।
এ
আয়াতের ব্যাখ্যায় মহানবী (সাঃ) বলেন, "এ আয়াতে যে ক’টি নাম এসেছে এগুলো নূহ (আঃ)-এর
কওমের বুজুর্গ লোকদের নাম। তাদের মৃত্যুর পর শয়তান ঐ সম্প্রদায়ের লোকদের প্ররোচিত
করলো, তারা যেন ওইসব বুজুর্গগন যেসব আসরে বস্তেন সেখানে তাদের প্রতিমা বানিয়ে রাখে
এবং তাদের নামে এগুলোর নামকরণ করে। তারা তাই করলো। তবে এগুলোর উপাসনা হতো না। এসব
লোক মৃত্যুবরণ করার পর শয়তানের চক্রান্তে ক্রমাম্বয়ে তাওহীদের বিস্মৃত হলো, তখন
এগুলোর উপাসনা ও পূজা হতে লাগলো” (বুখারী, ৪৯২০)।